অন্য ডুয়ার্স

পোরা পোড়া নয়

কোথায় যাচ্ছি? কেন যাচ্ছি? কিছুই জানি না। রাজদা বলল, চলো রাজা। আমিও এক পায়ে খাড়া। শেষে ট্রেন ছাড়ার পর আর থাকতে না পেরে জিগ্যেশ করেই ফেললাম, “রাজদা, একটু বলবে প্লিজ, চলেছি কোথায়?”

  • তুমি তো নতুন জায়গায় বেড়াতে যেতে চেয়েছিলে, সেখানেই যাচ্ছি।

  • বুঝলাম। জায়গার নাম না হয় উহ্যই থাক। কিন্তু সেখানে আছেটা কী?

  • কী চাও তুমি? প্রথমেই বলে দিই যা চাও তা হয়তো পাবে না। তবে যা পাবে সেটা চাওয়ার থেকে কম না বেশি সে বিচারের ভার তোমার ওপরেই ছাড়লাম। আর পরিচিত হবে অনেক মানুষের সঙ্গে।

ভ্রমণ সাংবাদিকতা শুরু করা ইস্তক, এর আগে পর্য্যন্ত এমন অনিশ্চয়তায় পড়িনি কখনো। গোড়া থেকেই শুরু করা যাক। বেশ কিছুদিন বের হওয়া হয়নি কোথাও। লেখার রসদেও টান পড়েছে। একদিন গল্পের ছলে হেল্প ট্যুরিজমের রাজ বসু-কে জানালাম মনের কথা। রাজদা খালি হেসে বলেছিলো, “দেখা যাক।”

ভরা বর্ষা। তখন আছি শিলিগুড়িতে। এক বর্ষণমুখর সকালে হঠাত রাজদার ফোন, “দুপুরে অফিসে এসো। কাল ভোরেই বেরবো দিন চারেকের জন্য।”

বোঝো!

পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় বৃষ্টি মাথায় বেরিয়ে পড়া। রাজদা, সঙ্গে তাঁরই এক বন্ধু সুনীলজী। (পরে জানা গিয়েছিল পুরো নাম সুনীল চহ্বান। নিবাস সিমলা। আদি বাড়ি হিমাচলেরই স্পিতি। নেশা ঘুরে বেড়ানো আর ফোটোগ্রাফি)। প্রাথমিক গন্তব্য এনজেপি। সেখান থেকে অসমগামী কামরূপ এক্সপ্রেস। ট্রেন ছাড়ার পরেই উপরিউক্ত কথোপকথন।

ট্রেনের চাকা গড়ায়, আসতে আসতে খোলসা হয়। চলেছি ডুয়ার্স। তবে পশ্চিমবঙ্গে স্থিত ডুয়ার্স নয়, অসম-এর ডুয়ার্স। ভারত সংলগ্ন ভুটানের ১৮টি দুয়ারের ৮টি-ই সেখানে। যা পৃথিবীর সব থেকে বৈচিত্রময় অরণ্যে উন্মুক্ত। মানস বায়োস্ফেয়ার। যেটি একাধারে জাতীয় উদ্যান, টাইগার রিজার্ভ, এলিফ্যান্ট রিজার্ভ এবং অবশ্যই ইউনেস্কো স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ব্যস আর পায় কে! আহ্লাদিত এবং বিগলিত মন ট্রেনের সংগে পাল্লা দিয়ে ডুয়ার্সের কোলে।

বিস্তীর্ন ডুয়ার্স অঞ্চল, ইংরেজরা এ দেশে আসার আগে ছিল ভুটান রাজাদের সম্পত্তি। কিন্তু বণিক ইংরেজরা এ অঞ্চলে পা দিয়েই ভৌগলিক ভাবে এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে। স্বাভাবিক ভাবেই লাগে ভুটান রাজার সঙ্গে বিবাদ, যার পরিণতি যুদ্ধ। অবশেষে ১৮৬৫-র সিঞ্চুলা চুক্তিতে যুদ্ধের অবসান হল, তবে ডুয়ার্সের দখল ইংরেজদের হাতে আসার পর। এ ইতিহাস জানা। কিন্তু পরবর্তিতে পদে পদে একথা মনে করতে হবে ভেবে মহাপুরুষদের বাণী স্মরণ। অধিকন্তু ন দোষায়ঃ।

মিনিট দশ বিফোর টাইম কামরূপ এক্সপ্রেস ঢুকলো নিউ বঙ্গাইগাঁও স্টেশনে। তখন সকাল সাড়ে এগারোটা। প্ল্যাটফর্মে আলাপ হল আমাদের রিসিভ করতে আসা রাজদার আর এক বন্ধু সৌম্যদ্বীপ দত্ত-র সঙ্গে। ইনি অসমিয়া ভাষায় বিখ্যাত ভ্রমণলেখক। শুধু ভ্রমণ নয়, বিষয় বৈচিত্রও অবশ্য অবাক করার মতন। সেসব যথাস্থানে। প্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরে আসতে গিয়ে ওভারব্রিজ পেরোতে হয়। তার উপর উঠতেই মন ভাল হয়ে গেলো। কালো মেঘে ঢাকা আকাশ। সামনে আর ডাইনে ছোটো ছোটো টিলা পাহাড়ে গা জড়াজড়ি। এগুলো যে হিমালয়ান রেঞ্জ নয় সে তথ্য টুক করে জানিয়ে দিল রাজদা।

প্রথম গন্তব্য অভয়াপুরী। স্বাধীনতার আগে এই অঞ্চলে অনেকগুলি ছোটো ছোটো স্বাধীন জমিদারী বা রাজত্ব ছিল। তারই একটি। প্রসঙ্গত বলা যায় কাছেই গৌরিপুর অঞ্চলের রাজা ছিলেন বিখ্যাত হাতি বিশেষঞ্জ লালজী বরুয়া বা প্রকৃতীশ বরুয়া। যিনি প্রখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যাক্তিত্ব প্রমথেশ বরুয়ার ভাইও। আপাতত অভয়াপুরী বঙ্গাইগাঁও জেলার অন্তর্গত। যা একসময় ছিল গোয়ালপাড়া জেলার অংশ। স্বাধীনতার আগে অবশ্য গোয়ালপাড়া নিজেই ছিল রংপুর জেলার অংশ।

অভয়াপুরী একটি ছিমছাম ছোটো জনপদ। টিপিক্যাল পর্যটকের চোখে আপাতদৃষ্টিতে কিছুই নেই। তবে চমক অপেক্ষা করেছিল। ততক্ষণে মেঘ কেটে রোদ। সঙ্গে চিটপিটানি গরম। ঘামে গা চুলকোয়। জানা গেল অক্টোবর থেকে মার্চের শেষ, এখানকার আবহাওয়াই ভীষণ মনমুগ্ধকর। এটা অগাস্টের শুরু। সৌম্যদার প্রস্তাব একটু দই কিনে নিয়ে গেলে হয়। টক দই। তার আগে বলি অসমে প্রবেশ ইস্তক, বাঙলা হরফে লেখা পড়তে গিয়ে বিষম লাগার কথা। যেমন চিল্ক (সিল্ক), চিমেন্ট (সিমেন্ট) প্রভৃতি। সব থেকে চমকপ্রদ ‘ইয়তে ভাত পোরা যায়’। এবারে চমক ‘গাখীরা’। আর থাকা গেল না। প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো। সৌম্যদা খুব যত্ন নিয়েই জানালেন সব। আমরা চ কে চ পড়লেও অসমিয়া ভাষায় সেটা স। পোরা টা এ ভাষায় পোবা (পোওয়া), যার মানে পাওয়া। অর্থাত হিন্দির মতন ব আর পেট কাটা ব, দুটোর উচ্চারণই আছে। বাঙলায় দুটো ব থাকলেও আলাদা উচ্চারন নেই। তবে এ ভাষায় ব এর পেট কাটলে সেটা র হয়। জল মেশালেও যা ডাইলুট হওয়ার নয়। আমাদের র এখানে ওয় উচ্চারিত। গাখীরা মানে গরুর দুধ। গা অর্থে গরু, খীরা অর্থে ক্ষীর আসলে দুধ। এখানে গম্ভীর হয়ে ফান্ডা ঝাড়তে গিয়ে মুখ পুড়ল।

  • ও, ঠিকই তো। যেমন অসম আসলে অহম।
  • না, এটাও ভুল। ওটার উচ্চারন অখ্অম।

  • অখম?

  • না, অখ্অম।

অনেকবার লাগল ব্যাপারটা বুঝতে। পাঠক হয়তো বানানের তারতম্যে একেবারেই বুঝেছেন। পরবর্তীতে এরকম পদে পদে ঠেকা খেয়ে উপলব্ধি গাঢ় হয়েছিল।

নিঝুমপুরী নিগমঘোলা

ঠিক যখন ভাবতে শুরু করেছি নিজের মনে, এ কোথায় এলাম! হ্যাঁ, ছিমছাম জনপদ। কিন্তু চোখ জুড়নো প্রকৃতি কই, কিম্বা শিরদাঁড়া টানটান করা ইতিহাস! তখনই, হ্যাঁ, তখনই যেন জাদুবলে আবির্ভুত ময়-পুরী। অভয়াপুরী সংশোধনাগারের পিছনেই সবুজে মোড়া এক আস্তানা। আস্থা নেচার্স হোম অ্যান্ড ডেয়ারি। যে ডেয়ারির নিজস্ব উত্‌পাদন দই, কেনা হল খানিক আগেই। ফেসবুকের ফার্মভিলে যেন বাস্তব রূপে সামনে হাজির। মাঝামাঝি একটা দোতলা কটেজ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে একতলা আরও কয়েকটা। সামনেই বাঁধানো জলাধার। একঝাঁক হাঁস চড়ে বেড়াচ্ছে। মহানন্দে কলরব করে। জলাশয়ের অপর পাড়ে সারি দেওয়া গামার গাছ। পুরোটাই প্লান্টেশনের ফল। যার পিছনেই উঁকি মারে সবুজে ছাওয়া এক টিলা পাহাড়। সবুজের যে এত রকমফের হয় বর্ষায় এখানে না এলে জানাই হত না। এই রিসর্ট এলাকা এবং তার বাইরের জলাজমি আর পাহাড় সহ মোট দুহাজার হেক্টরের মালিক শৈলেশ চৌধুরি। নিজেই হাজির আপ্যায়নে। একদিকে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা, অন্যদিকে ফার্ম হাউজ। যেখানে গরুর সংখ্যা প্রায় দুশো। ব্যাপার স্যাপার দেখে বাকরহিত। তবে চমকের আরও বাকি ছিল। জানা গেল শৈলেশবাবু নিজে একসময় ছিলেন শিকারি। তারপর উপলব্ধি করেন বন ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা। তাই প্রকৃতিকে বাঁচাতে আসপাশের গ্রামের মানুষদের সংঘবদ্ধ করে এই উদ্যোগ। যা শুধু অভয়াপুরীতেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং কাজের পরিসর বাড়িয়েছেন জেলার বাইরেও।

এখানেই রাজ বসু, সৌম্যদ্বীপ দত্ত আর শৈলেশ চৌধুরি এই ত্রয়ীর সম্মিলিত ভূমিকাটা ছোট্ট করে বলে নেওয়া দরকার। লোয়ার অসমের বিস্তীর্ন অঞ্চল জুড়ে প্রায় পঁচিশ বছর ধরে কাজ করে চলেছেন এঁরা। প্রাথমিক ভাবে একক প্রয়াস, পরবর্তীতে যৌথ উদ্যোগ। পরের চারদিন ধরে যেটা বুঝলাম অন্তরের অন্তস্থলে। এক কথায় পর্যটনের প্রসার বললে এ কাজকে খাটো করে দেখা হবে। বরং বলা ভাল একটা নির্দিষ্ট দর্শনের অভিমুখে এই যাত্রা।

দুপুরের ভুরিভোজ সেরে বেরনো হল সাইট সিইং-এ। ঠিক কেতাবি সাইট সিইং নয়। বরং বলা ভাল, খুঁজে পাওয়া, প্রকৃতির সাথে স্থানীয় জনজীবনকেও। রিসর্টে থাকতেই নানান পাখির উপস্থিতি টের পাওয়া গিয়েছিল। যেমন ব্ল্যাক হেড ওরিয়ল, ট্রি পাই, স্পটেড মুনিয়া। সৌম্যদা জানালেন, বার্ড ওয়াচারদের জন্য এ এলাকা স্বর্গরাজ্য। শাল, সেগুন, গামারির জঙ্গলকে একপাশে রেখে গাড়ি চলল টিলা পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে আঁকাবাঁকা পথ ধরে। রাস্তার বাঁ দিক বরাবর বিস্তীর্ন জলাভূমি।

  • এই জল কি বর্ষার কারনে?
  • কিছুটা তাই। তবে এটা একসময়ের নদী। খাত বদলে গেলেও বিস্তীর্ন অঞ্চল জলাভূমি হয়েই রয়ে গিয়েছে। স্থানীয়রা বলে মরা মানস। এক সময় মানস নদীর গতিপথ ছিল।

গাড়ির সামনের সিট থেকে ঘাড় না ঘুরিয়েই আমার কৌতুহল নিরসন করলেন সৌম্যদা।

অবশেষে পৌঁছলাম খোরাগাঁও গ্রামপঞ্চায়েত এলাকায়। ছোট্ট এই গ্রামের নাম গেরামারি। শুনেই সৌম্যদার মন্তব্য, তার মানে আগে এখানেও গন্ডার আসত। গন্ডার মারা থেকেই গেরামারি নাম। রাজবংশী গ্রাম। যেখানে গাড়ি থামল তার সামনেই ডাল পালা বিস্তার করে এক প্রাচীন বটবৃক্ষ। যার উপর গ্রামের ছোটোদের খেলাধুলা আর পাশেই চাতালে গাঁও-এর বুড়োদের বৈকালিক আড্ডা। ডালপালা বিস্তৃত শুনে যদি শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের অনুষঙ্গ মনে আসে তাহলে এই মুহুর্তে তা বাতিল করা উচিত। আকারে বিস্তারে তার সঙ্গে এর কোনো তুলনাই হয় না। কিন্তু একটা জায়গায় এই গাছের বিশিষ্টতায় আছে নিজস্বতা। প্রকৃতি প্রেমিক হলে তাই এ স্থান অত্যন্ত পবিত্র। কারন নির্বিচারে গাছ কাটার যুগে, কোনো সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই, স্থানীয় মানুষের উদ্যোগেই টিকে গিয়েছে এই বটগাছটি।

সৌম্যদা তখন স্থানীয় ভাষায় বুড়োদের সঙ্গে গল্প জুড়েছে। সবটা না বুঝলেও মন দিলে খানিকটা যেন বোঝা যায়। তা থেকে এবং পরে জিগ্যেশ করে কয়েকটি তথ্য জানা গেল। বেশ চমকপ্রদ। এঁরা নিজেদের হিন্দু বলে দাবী করেন। কিন্তু এঁদের আরাধ্য দেবতারা হলেন এই বটগাছ, মনসা, গণেশ। তবে এদের ধর্মাচারণে বলির কোনো স্থান নেই। সৌম্যদার ব্যাখ্যা, এরা আসলে একসময়ে ছিলেন বৌদ্ধ। মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এমন অনেক দেব-দেবীর উল্লেখ আছে যা হিন্দু ধর্মেও পূজিত। যেমন গণেশ বা তারা। আসলে এদের বেশিটাই লৌকিক দেব দেবী। আর বট গাছ বা বোধিবৃক্ষ তো বৌদ্ধ মাত্রই পরম পবিত্র। সৌম্যদার সাম্প্রতিকতম গবেষণার বিষয়ও তাই। কিন্তু যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল, সেটা হল এই মানুষগুলির মধ্যেকার বিভ্রান্তি। উত্তরবঙ্গের রাজবংশীদের মতন এঁরা নিজেদের শিকড় সম্পর্কে খুব একটা নিশ্চিত নন। কেমন যেন সন্দিহান। ঠিক কোনটা, ভূল কোনটা এ নিয়ে খানিক যেন দোনামোনা ভাবও আছে। আসলে ইতিহাসই দায়ী এর জন্য। পুরনো রাঙামাটির বিস্তীর্ন উত্তর এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ছিল রাজবংশীদের এলাকা। তারপর রাঙামাটি ভেঙে হল রংপুর। মোটামুটি ভাবে রাজবংশী অধ্যুষিত অঞ্চল। এরপর Radclif সাহেবের বদান্যতায় রাজবংশীরা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লেন। এক অংশ পেল বাংলাদেশের নাগরিকত্ব, বাকি দুই অংশের ঠাঁই হল যথাক্রমে পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমে। মূল ভাষা এক থাকলেও বিভাজন হল সেখানেও। ভাষাভিত্তিক এবং বলা ভাল হরফভিত্তিক। পাঠক হয়তো জানেন ইংরেজরাই গ্রেটার অসমে বাংলা ভাষাকে প্রধান দেশীয় ভাষা হিসেবে চালু করে। যার প্রভাবে অসমিয় হরফে বাংলার হরফের গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মোটকথা একটা চরম দড়ি টানাটানির দাম দিতে হল রাজবংশীদের। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন যাঁরা, তাঁরা নিজের শিকড়কেই ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলতে লাগলেন।

পরের গন্তব্য গণেশ মন্দির। খানিক আগের ধর্মভিত্তিক ধাঁধাটার সমাধান হল এখানে এসে। প্রায় বারো’শ বছরের পুরনো মন্দির। আনুমানিক এক হাজার থেকে এগারো’শ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বক্তিয়ার খিলজির সেনাবাহিনীর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। সম্প্রতি স্থানীয় মানুষ একটি গণেশের মূর্তি উদ্ধার করেন এখান থেকে। তারপর হিন্দু দেবতা হিসেবে নতুন মন্দির নির্মান করে সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। আসল মন্দিরের যে ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার হয়েছে, তার থেকে যে তথ্যগুলি জানা যাচ্ছে তা কিন্তু ইঙ্গিত দিচ্ছে, যে এটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল। প্রথমত এর গঠনশৈলি। যা নির্দেশ করে এটি পাল রাজাদের আমলে তৈরি। যাঁরা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। দ্বিতীয়ত রাজা ধর্মপালের বিখ্যাত ট্রেডমার্ক ধনুষ-খিলানের উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয়, সম্ভবত তাঁর আমলেই নির্মিত এ মন্দির। আর তিন নম্বর, মন্দিরটির প্রবেশ দ্বার পূবমুখি। যা হিন্দু মন্দিরের ক্ষেত্রে হয় না। যেমন নতুন মন্দিরটি কিন্তু পশ্চিমমুখি। যেহেতু দেবতা হিসেবে গণেশের উল্লেখ মহাযানী বৌদ্ধধর্মে পাওয়া যায় তাই সৌম্যদা আর রাজদা স্থির সিদ্ধান্তে, এটি বৌদ্ধমন্দিরই ছিল। পরে গণেশের মূর্তিটি দেখে সেই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হওয়াই স্বাভাবিক।

সেখান থেকে বেরিয়ে পরের গন্তব্যের দিকে রওনা। খানিকটা এন এইচ ৩৭, খানিকটা এন এইচ ৩১ ধরে এগনোর পর গাড়ি ঢুকলো ডানদিকে। অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তা। কিছুটা ওঠা, কিছুটা নামা। চারিদিকে টিলারা সব ঘনিয়ে আসে। জানা গেল ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় অবস্থিত এই সব টিলা পাহাড়ের গড় উচ্চতা মাত্র বারো থেকে চোদ্দ’শ ফিট। এ অঞ্চলের সব থেকে উঁচু টিলাটি, মাত্র আঠারো’শ ফিট উঁচু। যেটা আমরা পরের দিন দেখব।

নিগমঘোলা। এক সময় এই অঞ্চলে ছিল বাঙলা ভাষাভাষি মানুষের বাস। প্রকৃতির নির্জনতার কারনে জায়গার নাম হয় নিঃঝুম গোলা। পরে যা অপভ্রংশ হয়ে দাঁড়ায় নিগমঘোলায়। গোলা বা ঘোলা অর্থ চারিদিক পাহাড় বেষ্টিত সমতল স্থান। মানে বলে না দিলেও চলত। মুখের কথা আটকে গিয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরলে চোখে পড়বে ঢেউ খেলানো টিলার সারি। যেন প্রকৃতি আপন খেয়ালে মাঝের সমতলকে ঘিরে দেওয়াল রচনা করেছে। যার মাথায় অস্তগামী সুর্য আর বাদল মেঘের লুকোচুরি। রাজদা জানাল, এই জায়গাকে ধুরা হিসেবে ব্যবহার করা হত।  ধুরা মানে হাতি ধরার জায়াগা বা এলিফ্যান্ট ক্যাম্প। একসময় নিজেদের প্রয়োজনে ইংরেজরা গৌরিপুরের রাজা লালজী বরুয়াকে বরাত দিয়েছিল জঙ্গলি হাতি ধরে প্রশিক্ষিত করার। শুধু অসম নয়, পূর্ব হিমালয় সংলগ্ন বিস্তীর্ন অঞ্চলে লালজী এরকম অনেকগুলি ধুরা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অনেকেরই হয়তো খেয়াল আছে মিরিক-এর পথে গাড়িধুরা নামে একটি জায়গা আছে। সেটিও লালজীর ক্যাম্প ছিল। বন্য হাতিকে তাড়িয়ে নিয়ে আসা হত এই প্রাকৃতিক দেওয়ালের ফাঁদে, তারপর তাকে ধরে প্রশিক্ষিত করা হত। এ কাজে সাহায্যের জন্য লালজী গারোদের কাজে লাগাতেন। প্রধান হাতি ধরিয়েকে বলা হত ফান্দি। গারোরা ভাল ফান্দি হতে পারত।

আগে এখানে বাঙলা ভাষাভাষির মানুষ থাকলেও এখন এটি সম্পূর্ণ গারো অধ্যুষিত গ্রাম। সমতলে বছরে একটাই চাষ। সৌম্যদার তথ্য অনুযায়ী, বর্ষাকাল ছাড়া এখানে জলের কোনো উত্‌স নেই। এমনকি মাটির নিচের জলও মেলে না বললেই চলে। তাই বর্ষার মরশুমে ধানের চাষ ছাড়া এখানকার প্রাকৃতিক ফসলকে কৃষি কাজে বদলেছে গারোরা। সেগুলি হল আনারস, কমলালেবু, কলা আর অসমের বিখ্যাত তাম্বুল অর্থাত্‌ সুপারি। এই গ্রামে আপাতত দেড়’শ ঘর অধিবাসীর বাস। তাদেরই একটা বড় অংশ এগিয়ে এসেছেন প্রকৃতি সংরক্ষণের কাজে। সেই কাজকে অর্থনৈতিক ভাবে সফল করার দায়িত্ব নিয়েছেন আমার সঙ্গীরা। চৌধুরিদার সহায়তায় পাহাড়ের ঢালে তৈরি হয়েছে দিব্যি এক নির্জন গাছবাড়ি। এক রাত কাটিয়ে যাওয়ার লোভনীয় হাতছানি উপেক্ষা করা বেশ কঠিন। আমারও ইচ্ছে ছিল থাকার, কিন্তু বর্ষার কারনে সে ইচ্ছেয় সমবেত বাধা পড়ল। আতিথেয়তায় এগিয়ে এলেন গাঁওবুড়া সুবিন মারেক। না, পর্যটন ব্যবসায় একটি পয়সার আমদানি তাঁর হয় না। চানও না। শুধু এলাকাটা বাঁচবে, মানুষ জানবে, আর তিনি বিভিন্ন মানুষের সাথে মিশতে পারবেন, এই তাড়নাতেই গ্রামের একটা বড় অংশকে নিয়ে তিনি এই কর্মযজ্ঞের অংশীদার। আফশোষ করলেন থাকবনা শুনে। আমাদের আপ্যায়নে নিজেদের ট্র্যাডিশনাল ডিশ খাওয়ানোর কথা নাকি ভেবেছিলেন। দোখাপ্পা। ডুমুরের পাতায় জড়িয়ে বিশেষ প্রণালিতে রাঁধা মাংসর পদ। একেবারে গারো ঘরানার। সঙ্গে পানীয়, সু। আদতে রাইস বিয়ার বলা চলে। ভেবেছিলাম জিভের জল জিভেই রইল। কিন্তু ভুল প্রমান করতেই যেন এগিয়ে এলো লক্ষী মারেক। অষ্টাদশী গারো সুন্দরী। প্রথমে হাতে হাতে তুলে দিল গ্লাস ভর্তি সুস্বাদু সরবত্‌। শুনলাম কাঁচা কমলালেবুর খোসা দিয়ে তৈরি! এরপর এলো এখানকার বিখ্যাত মালভোগ কলা। শেষ হতে না হতেই মিষ্টি আনারসের স্বাদে মন ভরে গেল। তারপর এক বিচিত্র স্বাদের পিঠে। হ্যাঁ, পিঠে। ওদের ভাষায় পিঠা। নোনতা, মিষ্টি, ঝাল সব স্বাদেই ভরপুর। উপকরণ? অনেক পেড়াপেড়ির পর জানা গেল। চাল গুঁড়ো, বেসন, পেঁয়াজ, আলু, গুড় বা চিনি আর…, না আরটা ভাঙল না লক্ষী। ট্রেড সিক্রেট। কিন্তু মন জিতে নিয়েছে ততক্ষনে। তারপর চা আর সব শেষে পরম যত্নে এগিয়ে ধরল রূপালি বাটা। যাতে আছে কাটা পান, কৌটায় চুণ আর অবশ্যই জলে ভেজানো তাম্বুল। অনেকেই নিল, আমি সাহস করলাম না। পুরনো এক অভিজ্ঞতা মনে পড়ায়।

ইচ্ছে না করলেও নেমে আসা আঁধারের ভ্রূকুটিতে অভয়াপুরীর পথ ধরতেই হল। মনে মনে বললাম, আবার আসব লক্ষী। থেকে যাব তোমাদের আতিথেয়তায় গাছবাড়িতে একটা রাত।

ভূমিপুত্ররা

সারাদিনের চিটপিটে গরমের পর সন্ধে গড়াতেই নামল বেজায় বৃষ্টি। বৃষ্টির ছাঁটে শরীর জুড়োতে জুড়োতে খাওয়ার ঘরের বাইরের বারান্দায় বসল জমিয়ে আড্ডা। আমরা পঞ্চ-পান্ডব তো ছিলামই সঙ্গে যোগ দিলেন আর একজন। দে-দা। পুরো নাম এন কে দে। বঙ্গাইগাঁও রিফাইনারির কর্মী। রাজদা এসেছে শুনে দেখা করতে হাজির। ভাগ্যিশ! না হলে সর্ব অর্থে রসিক এই মানুষটির সঙ্গে পরিচয় হত না। একাধারে খাদ্য রসিক, আড্ডাবাজ আর তার সঙ্গে অসম্ভব জঙ্গলপ্রেমী। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর আদর্শ উদাহরণ। যে কর্মকান্ডের হদিশ পেয়েছি পরের তিনটে দিনে। একাধিকবার।

আড্ডার বিষয় স্থানীয় মানুষ এবং তাঁদের চেতনার বদল। এ প্রসঙ্গে এই আড্ডার সারমর্ম, পরিসংখ্যান সহ তুলে ধরলে বোধহয় এই বিস্তীর্ন এলাকাকে চিনতে আর বুঝতে সুবিধে হবে। গারোদের কথা খানিক বলেছি। এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতির কারনটা বলা যাক। আগেই বলা হয়ছে ১৮৬৫-র আগে এটি ছিল ভুটান রাজাদের অংশ। ব্রিটিশরা আসার পর স্থানীয় জমিদার বা করদ রাজাদের একটা অংশ ভুটানের প্রতি তাঁদের আনুগত্য বজায় রাখেন। তাই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়তে তাঁরা নিজস্ব সেনা বাহিনীও গঠন করেন। লড়াকু হিসেবে সুনাম ছিল গারোদের। তাই সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ানোর জন্য গারোদের আনা হয়। যেমন অভয়াপুরীর রাজাও আনিয়েছিলেন। তারপর তারাই নানান দিকে ছড়িয়ে গিয়ে অসমের এ অঞ্চলের বাসিন্দা হয়ে ওঠে।

এবার আসা যাক রাভাদের কথায়। সৌম্যদার কথা অনুযায়ী রাভারা আদতে পশ্চিম চিনের লোক। তখন অবশ্য চিন দেশ বলে কিছু তৈরি হয়নি। এমনকি চিনের লেখ্য ভাষার ছবিওয়ালা হরফও তৈরি হয়নি তখন। সে সময় ছিল সাং রাজবংশের শাসন। রাভাদের তারা মূলত দাস হিসেবে কাজে লাগাত। সেই অত্যাচার থেকে বাঁচতেই ওরা ক্রমশ পশ্চিম দিকে সরে আসতে শুরু করে। অধুনা মায়ানমার এবং ভারতের অরুণাচল, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড হয়ে তারা ধীরে ধীরে মেঘালয়, অসম এবং উত্তরবঙ্গেও প্রবেশ করে। শতকের পর শতক তারা এক সাংস্কৃতিক পরিবর্তেনর মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে, আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। ফলে ওদের নিজস্ব কোনো লেখ্য ভাষা নেই। কথ্য ভাষাতেও কালে কালে স্থানীয় ভাষা এবং অন্যান্য আদিবাসী জনজাতির ভাষা মিশতে শুরু করে। তার মধ্যেও এরা আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেদের সেই শিকড়কে খুঁজে পেতে, নিজেদের আহরিত সংস্কৃতির মধ্যে।

ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায়, সংখ্যার দিক থেকে সবথেকে বড় জনজাতির প্রসঙ্গে এবার আসতেই হবে। যারা অসমের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। বোড়ো। বোড়োদের আদি শিকড় নিয়ে সৌম্যদা, রাজদা ছাড়াও বহু ইতিহসবীদ ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। এমনকি বোড়োরা নিজেরাও। বোড়োদের একাংশের বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের শিকড় তিব্বত এবং ভুটানের গভীরে প্রথিত। কেউ কেউ মনে করেন অধুনা মায়ানমারের কোনো অংশ থেকে এদের আগমন। কিন্ত যুক্তি তর্ক এবং পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এরা এই অঞ্চলেরই বাসিন্দা। মহাভারতে যে কিরাত শ্রেণীর কথা উল্লিখিত আছে, আজকের বোড়োরা তাদেরই আধুনিক রূপ। কিরাত অর্থে সেই সমস্ত আধা যাযাবর মানুষ যাদের জীবন নির্বাহ কৃষি ভিত্তিক ছিল না। যারা প্রকৃতির উপর নির্ভর করত। যেমন জঙ্গলের ফলমূল, বিভিন্ন পশু পাখির মাংস যা শিকার করে পাওয়া যেত এবং নদীর মাছ। এদেরই একটা অংশের দীর্ঘদিনের বাস উত্তরবঙ্গ ও অসম-এর বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে। এমনকি সমতল লাগোয়া পূর্ব নেপালেও। নেপাল ভারত সীমান্তের মেচি নদী সংলগ্ন এই জনজাতিকে আমরা চিনি মেচ নামে। কারো কারো মতে এরাই আবার নেপালের ধুমল বা ধীমল। অসম অংশে এরাই পরিচিত বোড়ো নামে। আর একটি সূত্র বলছে অন্য কথা। যে ব্যাখ্যা বোড়োদের একটা অংশ মানে। বোড়োরা আসলে দিমাসা জনজাতি থেকে এসেছে। ভাষাগত ভাবে যারা টিবেটো-বার্মিজ ফ্যামিলির অন্তর্ভুক্ত।

মোট কথা একটা ব্যাপার নিশ্চিত বোড়োরা এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা। সে অর্থে তাদের ভূমি-পুত্রও বলা যায়। স্বতন্ত্র আদিবাসী জনজাতির স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে বোড়োদের, ভারতীয় সংবিধানে। বোড়োদের কথা আলাদা করে বলার প্রধান কারন বিগত শতকের শেষ আড়াই দশকের অশান্ত অসম-এর মূল চিত্রটা বুঝে নেওয়া। না হলে যেমন এদের ভুল বোঝার অবকাশ থেকে যায়, তেমনই অসম বলতেই অনেকের মনে যে আতঙ্কের ছবি তৈরি হয় সেই ভ্রান্তিটাও কাটানো যায়। এখানে একটা ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। হয়তো অনেকেই একমত হবেন। একজন সাংবাদিক হিসেবে প্রায় কুড়ি বছর কাটিয়ে দিলেও মানস ন্যাশনাল পার্কের অস্তিত্বের খবর, মাত্র দশ বছর আগেও জানা ছিল না। মানস বলতেই বুঝেছি, মানস সরোবর। এমন কি অসম থেকে ফেরার পর শিলিগুড়িতে পাড়ার খবরের কাগজ বিক্রেতা দাদা দেখতে পেয়ে জানতে চেয়েছিলেন, কোথাও গিয়েছিলাম নাকি? মানস গিয়েছিলাম শুনে তাঁর তাত্‌ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, বাবা, সেখানে তো বেজায় ঠান্ডা। অর্থাত্‌ তিনিও ধরে নিলেন, আমি মানস সরোবর গিয়েছিলাম। নিজেকেই প্রশ্ন করি এর কারনটা কি? একটা কারন হয়তো জানতে চাওয়ার অনীহা। কিন্তু নিশ্চিতভাবে আরেকটি কারন বাংলার সংবাদ মাধ্যমে গোটা ভারতের তুলনায় উত্তর-পূর্ব ভারতের চোখে পড়ার মতন অনুপস্থিতি। বিশেষত অসম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম এবং অনেকটাই অরুণাচল। অনেক ভেবে একটা যুক্তিগ্রাহ্য কারন নিজের সামনেই খাড়া করা গিয়েছে। সেটি একেবারেই ব্যক্তিগত মতামত, তবু বলা যেতে পারে। অন্য মত পেলে সেটাও তো কম লাভের নয়।

ব্রিটিশদের সময় বাংলা সহ গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের কাজের ভাষা হিসেবে বাংলা-কে চাপিয়ে দেওয়ায়, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বাঙালিরাই অগ্রাধিকার পেয়ে এসেছে। অসম এবং মণিপুরের বাসিন্দারা বাংলা হরফকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। (সম্প্রতি মণিপুরি ভাষার নিজস্ব হরফ তৈরি হয়েছে। এখনও কাজ চলছে)। এই চিত্রটা স্বাধীনতার পরেও বদলায়নি। (তাই ক্ষোভ ছিলই। এবার অসমের মতন বৈচিত্রময় জনবসতির রাজ্যে, যখন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন তৈরি হল, তাতে এক অংশের এলিট ক্লাসেরও নীরব সমর্থন ছিল। তাই সেই আন্দোলন রাতারাতি বাঙালি খেদাও আন্দোলনে রূপান্তরিত হতে সময় নেয়নি। এর ফলে একদিকে যেমন দীর্ঘদিনের বসবাস ছেড়ে বহু বাঙালিকে অসম ছাড়তে হয়েছে, তেমনই প্রাণও গিয়েছে অনেক)। হয়তো এটা একটা কারন বাঙলা সংবাদমাধ্যমের অসম-এর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার।

১৯৭৯ তে আলফা (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ অসম) গঠিত হওয়ার পর শুধু বাঙালি বিরোধী আন্দোলনই নয়, একের পর এক বিচ্ছিন্নতাবাদী রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছে অসম। আমরা শুধু খবরে পড়েছি সেই আন্দোলনে হিংসার কথা অথবা সেনাবাহিনীর সাফল্যের কথা। ১৯৯০ এ সেনা সক্রিয় হওয়ার পর এবং বাঙলাদেশ সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আলফা নেতারা গ্রেফতার হওয়ার পর গতি হারায় আলফা-র আন্দোলন। ইতিমধ্যে পৃথক বোড়োল্যান্ডের দাবীতে ১৯৮৬-তে বোড়ো সিকিউরিটি ফোর্স শুরু করে বোড়ো আন্দোলন। প্রাথমিক ভাবে যার নেতৃত্বে ছিল অল বোড়ো স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা আবসু। এই সময়ে অসমে বাগানিয়া নামে পরিচিত হয়ে ওঠা, শতাধিক বছর ধরে বাস যে সব আদিবাসী জাতির, তাদের বিরুদ্ধেও শুরু হয় সক্রিয় আন্দোলন। মূলত সাঁওতাল, ওরাঁও, মুন্ডারা নিশানায় চলে আসে। অপরাধ? নতুন তৈরি চা-বাগানে কাজ করার জন্য ছোটানাগপুর অঞ্চল থেকে এদের নিয়ে এসেছিল ব্রিটিশরা। কোথাও লোভ দেখিয়ে, কোথাও গায়ের জোরে। তাই এরা অসমের মানুষ নয়। এদেরও তারাও। এরা ছাড়াও ২০০০ সালে নিশানায় আসে বাঙলাদেশী মুসলিম উদ্বাস্তুরা। মোদ্দা কথা এলাকার মানুষের বঞ্চনা। অসম থাকবে শুধু অসমের মানুষের। ১৯৯৩-এ আবসু-র নেতৃত্বে সরকারের সঙ্গে বিএসি (বোড়ো অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল) সংক্রান্ত চুক্তি সই হয়। কিন্তু সরকার ২৭৫০টি গ্রামকে এই কাউন্সিলের আওতায় আনতে অস্বীকৃত হয়। কারন এই গ্রামগুলিতে বোড়ো জনসংখ্যা গ্রামের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশেরও কম। এরই প্রতিবাদে স্বাধীন বোড়োল্যান্ডের দাবীতে আন্দোলন করা একটা গোষ্ঠী বেরিয়ে আসে। বাকিরা চুক্তি মেনে নেয়। যারা চুক্তি মেনে ছিল পরবর্তীতে তাদের ভূমিকা প্রসঙ্গে যথাসময়ে আলোচনা করা যাবে। বেরিয়ে যাওয়া অংশটা নিজেদের নতুন নামে পরিচিত করায়। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অফ বোড়োল্যান্ড বা এনডিএফবি। মূলত এদের নেতৃত্বেই শুরু হয় আদিবাসীদের উপর আক্রমণ। যার পাল্টা ১৯৯৬ এ তৈরি হয় আদিবাসী কোবরা ফোর্স। সামগ্রিকভাবে কিন্তু অসমের বিচ্ছিন্নতা আন্দোলন একটু একটু করে গতি হারাতে শুরু করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রথম যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল অসমের সমস্ত জনজাতিকে এক সাথে নিয়ে, পরবর্তীতে সেই আন্দলনই ক্রমে ক্রমে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী ভিত্তিক হয়ে দাঁড়ায়। এক সময়ের জঙ্গীরা মূলস্রোতে ফিরে আসতে শুরু করেন। এরপর ২০০৫ সালে সরকারের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই হয় এনডিএফবি-র। কিন্তু কায়েমী স্বার্থ সেটা মেনে না নিতে পারায় আবার একটা উপদল গঠিত হয়। যার নাম এনডিএফবি(এস)। মজার ব্যাপার এই দলের সর্বময় কর্তা নিজে কিন্তু বোড়ো জনজাতিভুক্ত নন। ইতিমধ্যে বিএসি থেকে রূপান্তরিত হয়ে গঠিত হয়েছে বিটিসি (বোড়ো টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল)। এরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই বোড়োল্যান্ডভুক্ত অঞ্চলের স্বায়ত্ব শাসন বজায় রেখেছে।

অস্থির অসমে কিন্তু ১৯৯৩ থেকেই শুরু হয়ে যায় গতি পরিবর্তনের কাজ। ২০০৩ এ এসে যা শুধু গতিই ফিরে পায়নি বিশ্বের দরবারে অসমবাসী তথা ভারতের মাথা উঁচুও করেছে। অথচ প্রতিবেশী রাজ্য হয়েও আমরা সে ব্যাপারে থেকেছি উদাসীন। বিস্তারিত ভাবে সে প্রসঙ্গে আসব মানস বায়োস্ফেয়ারে প্রবেশ করার সময়। মোট কথা এই প্রেক্ষিত-এ দাঁড়িয়েও কয়েকজন প্রচারবিমুখ মানুষ অক্লান্ত কাজ করে গিয়েছেন, এখনও যাচ্ছেন, রাজ্যের বিপুল বনসম্পদকে বাঁচানোর তাগিদে।

সোনালি বানরের দেশে

আজ সকাল সকাল বেরনো হল। চৌধুরিদাও আজ সঙ্গী। অনেকটা যেতে হবে। অনেক কিছু দেখতে হবে। বঙ্গাইগাঁওর সীমা ছাড়িয়ে যাব কোকরাঝাড় জেলায়। আজও সঙ্গী জাতীয় সড়ক ৩১। শেষে এক জায়াগায় জাতীয় সড়ক ছেড়ে গাড়ি বাঁক নিল ডানদিকে। খানিকটা যেতেই রাস্তার দু-ধারের শাল গাছের শামিয়ানায় রোদ হার মানলো। স্নিগ্ধ হল পরিবেশ। কিছুটা গিয়েই গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা ছোট্ট তে-মাথা। সামনে ডানদিকে পরিসর ঘাস জমি। খানিকটা বন্ধুর না হলে মাঠ বলা চলত অনায়াসেই। সেখানেই একতলা লম্বা একটা ঘর। দেখেই বোঝা যায় স্কুল। তখনই চোখে পড়ে সামনেই বোর্ড লাগানো। স্কুলের নাম ‘ধম্মা দীপা’। সেখান থেকেই উদ্ধার হয়, আমরা এখন কোকরাঝাড় জেলার ভাটিপাড়া অঞ্চলের বামনগাঁও-এ। রাজদার কাছেই জানলাম হালেই এই স্কুল শুরু হয়েছে। আর এটা রাজদার একটা স্বপ্ন-প্রকল্প। যাতে সর্বত ভাবে সাহায্য করছে বোড়ো টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল। আর প্রকল্প সহায়তায় আছে নর্থ-ইস্ট বুদ্ধিস্ট সংঘ কাউন্সিল। এমনকি স্কুলের উদ্বোধন করেছেন বিটিসি প্রধান মলিহারিজী  এবং সঙ্গে ছিলেন এই প্রকল্পে রাজদার প্রধান বন্ধু, দার্শনিক তথা পথপ্রদর্শক বিটিসি উপপ্রধান খাম্পা বরগোয়ারি। তবে স্থানীয় ভাবে সমস্ত কিছু দেখভালের দায়িত্বে আছেন বিশিরাম নার্জারি।

এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে মাথায় রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ এই অঞ্চলটাকে পর্যটন হাব হিসেবে গড়ে তোলা। তার আর একটা কারন এখান থেকে খুব কাছেই চক্রশিলা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি। যেহেতু এলাকার আদিবাসী জনজাতিদের একাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী তাই এখানে একটি বৌদ্ধ মন্দির এবং তারা মন্দির গড়ে তোলার পরিকল্পনাও আছে। স্কুল দেখা শেষ করে পায়ে হেঁটেই জঙ্গলের ধার ঘেঁষে পদচারনা। খানিক এগোতেই নয়নাভিরাম দৃশ্য। দুদিকে জলাভূমির দীর্ঘ বিস্তার। যার শেষে দুদিকেই সবুজে মোড়া পাহাড় অতন্দ্র প্রহরায়। ইসসস, এখানে যদি একটা রিসর্ট থাকত। রাজদা শুনে খালি হাসল। কোনো মন্তব্য করল না। সুনিলজী মনের মতন বিষয় পেয়ে শুধু শাটার ধ্বনিতে ভরিয়ে দিয়েছেন আবহ।

চক্রশিলা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি। গোল্ডেন লাঙ্গুর বা সোনালি বানরের আঁতুর ঘর। গোল্ডেন লাঙ্গুরের জন্য ভারতের প্রথম তথা একমাত্র সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ১৯৯৪ এ স্যাংচুয়রির তকমা পায়। ভারতীয় বন্যপ্রাণ আইনে সিডিউল ওয়ান তালিকাভুক্ত প্রাণী গোল্ডেন লাঙ্গুর। জঙ্গলে প্রবেশের খানিক আগেই শালের ঘন বন দেখে মন উচ্ছসিত। যা দেখে সৌম্যদার মৃদু হাসি। জানা গেল, এটা জঙ্গলের অংশই নয়। একটা সময় বেআইনি দখলদাররা এসে নির্বিচারে বসবাস শুরু করে এখানে। গাছ কাটার পিছনে যেমন ওদের হাত ছিল তেমনই জঙ্গল ধ্বংসের আর একটা কারন অসমের জঙ্গী আন্দোলন। গত পঁচিশ বছর ধরে সৌম্যদার নেতৃত্বে তাঁর সংগঠন নেচার্স বেকন সাধারন মানুষের মধ্যে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তারই ফল, দখলদার হটিয়ে নতুন করে গাছ লাগানো। জঙ্গলকে কেন্দ্র করে যে ছত্রিশটি গ্রাম আছে তাদের সার্বিক জীবনধারার মানোন্নয়ন ছাড়াও প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং স্কুল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে নেচার্স বেকন। আজ এই অঞ্চলের রাভা, গারো, রাজবংশী, বোড়ো এবং মুসলিম অধিবাসীরা সর্বোত ভাবে সংরক্ষণের কাজে যুক্ত। তবে এদের দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের পথ আরও সুগম করতে এবার এখানে চালু হচ্ছে হোম-স্টে ট্যুরিজম। যা এবছরের(২০১৬) পুজোর আগেই শুরু হয়ে যাবে। আর কেন্দ্রে অবশ্যই গোল্ডেন লাঙ্গুর।

ধুবরি জেলা লাগোয়া এই বনাঞ্চল ৪৫ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত। মূলত টিলা পাহাড়ের গায়ের জঙ্গলই এর আওতায়। পাহাড়ের উপর দিকের উল্লখযোগ্য গাছ হল ত্রিফলা। অর্থাত্‌ আমলকি, হরিতকি আর বয়রা গাছ মেলে বিস্তর। শেষ সুমারি অনুযায়ী গোল্ডেন লাঙ্গুরের সংখ্যা ৮০০-র কিছু বেশি। এখানে ৩৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেখা মেলে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য লেপার্ড, লেপার্ড ক্যাট, জাঙ্গল ক্যাট, ফিশিং ক্যাট, বিগ ক্যাট (রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার)। এই মুহুর্তে সংখ্যায় তারা ৬। আর আছে ক্র্যাব ইটিং মঙ্গুজ, উদ্বিড়াল, মালায়ান জায়েন্ট স্কুইরেল, উড়ুক্কু কাঠবেড়ালি, প্যাঙ্গোলিন, বার্কিং ডিয়ার, সম্বর, গাউর, বুনো শুয়োর প্রভৃতি।

বনাঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে ধীর এবং দীপলাই বিল। যেখানে শীতকালে ২৮২ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। এর মধ্যে ধীর বিলটি চন্দ্রডিঙা পাহাড়ের পাশ দিয়ে মিশেছে ব্রহ্মপুত্রর সঙ্গে। চৌধুরিদা জানালেন আগ্রহী পর্যটকদের জন্য ব্রহ্মপুত্রে শুশুক দর্শনের ব্যবস্থাও আছে।

আমরা একটি রাভা বাড়িতে ঢুকলাম। গ্রামের গাঁওবুড়ার বাড়ি। প্রবেশের সাথে সাথে বৃদ্ধা ঘরনীর অনুযোগ সৌম্যদার উদ্দেশে, উনি নাকি এঁদের ভুলেই গিয়েছেন, তাই অনেকদিন বাদে এলেন। নিমেষে আমাদেরও আত্মীয়তার বন্ধনে জড়িয়ে নিলেন। দেখা গেল হোম স্টে-র ব্যবস্থা হচ্ছে এই বাড়িতেও। রীতি অনুযায়ী আপ্যায়িত হলাম পান-তাম্বুলে। কেউ নিলেন কেউ নিলেন না। গৃহিনী জানতে চাইলেন লাউপানি চলবে কিনা! লাউপানি? বোধহয় মুখের ভূগোল দেখেই রাজদা এগিয়ে এলো উদ্ধার করতে। লাউপানি-ও আসলে এক ধরনের রাইস বিয়ার। রাভা-দের নিজস্ব ঘরানার পানীয়। আসলে এরা কুম্ভকার হিসেবে কোনোদিন-ই দড় নয়, তাই প্রাচীন পদ্ধতিতে শুকনো লাউ-এর খোলে ফার্মেন্টেশন করা হত এই দেশীয় পানীয়ের। সেখান থেকেই নামকরন, লাউপানি। কিন্তু এই গরমে? গাঁওবুড়া জানালেন শরীর ঠান্ডা হয়। রাজদার বিনীত নিবেদন, প্রতিবেদক এবং চৌধুরিদা বাদে বাকিরা ও রসে বঞ্চিত। তাই সই। দুজনের জন্যই এলো। গরমের দুপুরে আপ্যায়িত হলাম। শরীর ঠান্ডা হল কিনা, সে প্রশ্ন অবান্তর।

কোকরাঝাড় পৌঁছে মধ্যহ্ণ ভোজন সারা হল। বিকেল চারটের সময় খাওয়াকে মধ্যাহ্ণ ভোজন বলা যাবে কিনা সেটা একটা প্রশ্ন। সেখানেই ভারি অদ্ভুত্‌ এক বিলবোর্ড চোখে পড়ল। যার সার মর্ম, “আমাদের সঙ্গে চলুন যমদুয়ার, উষ্ণ আতিথেয়তায় উপভোগ করুন প্রকৃতি।” মানেটা কি! যমের দোরে বেড়াতে যাওয়া! আমাকে হাসতে দেখে বাকিরা কিন্তু হাসল না। রাজদা বরং পরম যত্নে আমার সংশয় দূর করল। যমদুয়ার অসম ভুটান সীমান্তের আটটি দুয়ারের একটি। তবে যম দুয়ার নামকরন হয়েছে স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে। তার একটি সম্ভাব্য কারন হল, এক সময় ওই অঞ্চল থেকে আদিবাসী রমণিদের তুলে নিয়ে যাওয়া হত ভুটানে। যাদের আর খোঁজ পাওয়া যেত না কোনোদিন। অর্থাত্‌ যমের বাড়ি গেলে যেমন কেউ ফেরে না, তেমনি কোনো মহিলা ওই অঞ্চলে গেলে আর ফিরতেন না। তাই এই নাম। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নাকি অসাধারন। তাই এখন পর্যটন গন্তব্য হয়ে উঠেছে এক সময়ের কুখ্যাত যমদুয়ার। আমাদের হাতে সময় নেই তাই এ যাত্রায় যাওয়া হল না।

পরের গন্তব্য, উল্টাপানি। মানস বায়োস্ফিয়ারের মধ্যে দিয়ে ২৩ কিলোমিটার গিয়ে ভুটান সীমান্তের ১০ কিলোমিটার আগে এই গ্রাম। যার তিনদিক-ই জঙ্গলে ঘেরা। আরও একটি দুয়ার। ভুটানের সারভাং সীমান্ত। তবে আগে মানস নিয়ে কয়েকটি তথ্য দেওয়া যাক। মানস। স্থানীয় উচ্চারনে মানখ্‌। ১৯০৭ সালে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষিত হয়। ১৯২৮ সালে ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি। এরপর ১৯৮৫ তে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট, ১৯৮৯-এ বায়োস্ফিয়ার আর তার পরের বছরেই জাতীয় উদ্যান। বায়োস্ফিয়ার অঞ্চলটি ২৮৩৭ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত। তার মধ্যে জাতীয় উদ্যানের অংশ ৫২৬ দশমিক দুই দুই বর্গ কিলোমিটার! শুধু তাই নয় একাধারে মানস যেমন একটি টাইগার রিসার্ভ, তেমনই এরই একটি বিস্তীর্ন অঞ্চল চিহ্নিত চিরাং-রিপু এলিফ্যান্ট রিসার্ভ হিসেবে। অসমের ৬ টি জেলা জুড়ে বিস্তৃত এই বিশাল বনাঞ্চল। জঙ্গলের মধ্যে একটি মাত্র গ্রাম, আগরঙ্গ। তবে জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের সংখ্যা অনেক। বাপরে! তথ্য শুনে মনে হল উত্তরবঙ্গের জলদাপাড়া বা গরুমারা জাতীয় উদ্যান যেন বাড়ির পিছনের আগাছার জঙ্গল। তখনও জানা নেই আরও কত চমক অপেক্ষা করে আছে!

জাতীয় সড়ক ৩১ সি পার করে গাড়ি ঢুকলো উল্টাপানির রাস্তায়। ১২ কিলোমিটার যাওয়ার পরেই এসএসবি পথ আটকালো। পরিচয়পত্র দেখিয়ে তবে মিলল জঙ্গলে প্রবেশের অনুমতি। শুরু হল দুপাশে ঘন জঙ্গল। সৌম্যদা জানালেন জঙ্গল যতই ঘন হোক এটা কোর এরিয়া নয়। হঠাত্‌ সারথি রবিন গাড়ি দাঁড় করাল। যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। রাস্তার ধারের গাছে এক পাল গোল্ডেন লাঙ্গুর। বলতে ভুলেছি সকালে চক্রশিলাতে প্রথম দর্শন মিলেছিল গোল্ডেন লাঙ্গুরের। তবে সংখ্যায় ছিল মাত্র দুটি। এখানে ধেড়ে কচি মিলে প্রায় গোটা কুড়ি। তার সঙ্গেই বন্য কাঠবিড়ালি। জঙ্গল প্রবেশের সাথে সাথেই যেন উষ্ণ আপ্যায়ন। তারপর ২৩ কিলোমিটার ধরে শুধুই জঙ্গল। পুরো পথে আরও দুটি দৃশ্য চোখে পড়ল। একটি উত্‌সাহবর্ধক অন্যটি হৃদয় বিদারক। পথের একটা বড় অংশ জুড়ে হাতির পটি। দুদিন থেকে এক সপ্তাহের পুরনো। অর্থাত কপালে থাকলে দেখা মিলতে পারে। যে জঙ্গলে হাতির সংখ্যা ৬৫৮-রও বেশি (২০০৩ হস্তি সুমারি), সেখানে সম্ভাবনাটা প্রবলই বলা যায়। ফেরার সময় রাতের অন্ধকারে সে সম্ভাবনা তৈরিও হয়েছিল। টাটকা পটি সে ইঙ্গত দিয়েছিল, কিন্তু কপাল খারাপ সেনাবাহিনীর গাড়ি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আমাদের টপকে আগে গিয়ে সে সম্ভাবনায় জল ঢেলে দিয়েছিল। সেনাবাহিনীর বোধহয় জঙ্গলে গতি সীমা মানার প্রয়োজন হয় না!

দ্বিতীয় দৃশ্যটা হল সাইকেলে করে কাঠ নিয়ে যাওয়া। এমনিতে দৃশ্যটায় অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু কাঠের পরিমান আর তার কোয়ালিটি এটুকু ইঙ্গিত দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল যে এ কাষ্ঠ আহরণ সম্পূর্ণ আইনি নয়।

উল্টাপানি বাজারে ঢোকার আগে আর এক প্রস্থ চেকিং। এবার সেনাবাহিনী। উল্টাপানি বাজারে পৌঁছতেই দেখা হয়ে গেল ব্রহ্মাদার সঙ্গে। প্রবীন এই মানুষটি কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে বন আর বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের কাজ করে যাচ্ছেন। রাজদা-কে দেখে বেজায় খুশি। সঙ্গে অনুযোগ এত দিন বাদে আসার জন্য। বাজারে চা খেয়ে গেলাম গ্রামের মধ্যে গিরীন ভাইয়ের বাড়িতে। চৌধুরিদার সহায়তায় এখানে হোম স্টে-র ব্যবস্থা হয়েছে। আলাপ হল বৃদ্ধ মঙ্গল সিং গুরুং আর কনক নার্জারির সঙ্গেও। এরা সকলেই সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত প্রাণ। হ্যাঁ, এ গ্রামেও মানুষ বন্যপ্রাণের বিরোধিতায় হঠকারী। তবে এঁদের উদ্যোগে গ্রামের মানুষ এখন অনেক বেশী সচেতন। সহসা বন্যপ্রাণ হত্যা করার কথা আর ভাবেন না।

বাড়ির সামনে মুক্ত দাওয়ায় চেয়ার নিয়ে বসলাম। জমে উঠল জঙ্গল বিষয়ক আড্ডা। সামনে মেঘ মাখা বিষন্ন হিমালয়। বাম থেকে ডান যতদূর চোখ যায়। সুর্যও সদ্য মুখ লুকিয়েছে ভুটান সীমান্তের আড়ালে। বাদল মেঘে কোথাও কমলা কোথাও বা বেগুনি রঙের আঁকিবুকি। পাহাড়ের কোল ঘেঁষা দুই সহদরা মানস বায়োস্ফিয়ার আর রয়্যাল মানস-এর গাছেরাও যেন আসন্ন রাতের প্রস্তুতিতে গম্ভীর। পাখিদের ঘরে ফেরার ব্যস্ততা। তার মাঝেই গাছের মাথায় একা এক হর্নবিলের বিলাপ ধ্বনি। এক অন্যরকম ভাল লাগায় ভরে উঠল হৃদয়। মুছে গেল সকাল থেকে ছুটে চলার সমস্ত ক্লান্তি।

মাওজিগেন্দ্রি

কাল গিয়েছিলাম মানসের পশ্চিমতম প্রান্তে। আজ যাত্রা পূর্বতম দিকে। মানস জাতীয় উদ্যানের তিনটি রেঞ্জ। পানবাড়ি, বাঁশবাড়ি আর ভুঁইয়াপাড়া। আমরা এখন তৃতীয় রেঞ্জ সংলগ্ন লখখিবাজার এলাকায়। এখান থেকে ভুটান সীমান্ত নামলাং মাত্র ৮ কিলোমিটার। আলাপ হল চন্দ্রকান্ত বৌমাতারির সঙ্গে। তার বাড়ি ঘুরে এসে বসলাম আবসুর অফিস কাম মেস-এ। রাজদা জানালো এই অফিস অনেকগুলি কারন গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের সঙ্গে চুক্তির আগে এই অফিসই ছিল জঙ্গী কার্যকলাপের অন্যতম ঠিকানা। পরে ইউনেস্কো এবং ডাব্লিউ ডাব্লিউ এফ-এর প্রতিনিধিরা এখানে এসে বৈঠক করে গিয়েছেন। এমনকি সংরক্ষণ আন্দোলনকে গড়ে তোলার সময় এই মেসেই রাতের পর রাত কেটেছে রাজদার। আমরা এখন তিনজন। চৌধুরিদা বা সৌম্যদা এই পর্যায়ে নেই।

আলাপ হল বিরখাং বরগোয়ারির সঙ্গেও। পর্যটন প্রসারের নেতৃত্বে ইনি কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরেই। চন্দ্রকান্ত নিজেও একসময়ে সশস্ত্র আন্দোলনে সামিল ছিল। তবে আজ সে সম্পূর্ণ ভাবে সংরক্ষণ কর্মী। শুধু সে নয়, বোড়ো আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত একটা বড় অংশ আজ বুঝেছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই প্রয়োজন বন এবং বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ। রাজদার মতন বঙ্গাইগাঁও-এর দে-দারাও এদের মনভাব পরিবর্তনে ২৫ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। যার ফলস্বরূপ মাওজিগেন্দ্রি ইকো ট্যুরিজম সোসাইটির জন্ম। যাদের সহায়তায় ৮০ জন জঙ্গী পরবর্তীতে সংরক্ষণ আন্দোলনে স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকায় অবতীর্ন হয়। যাদের মধ্যে ৪০ জনের মাসোহারার ব্যবস্থা করেন বিটিসি-র উপপ্রধান খাম্পা সাহেব। এখন স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা ৩৩ জন। নিয়মিত মাসোহারা পায় তারা। জঙ্গী আন্দোলনের পথ ছাড়লেও এরা অস্ত্র ত্যাগ করেনি। একসময়ের মানুষ মারা যন্ত্র আজ এরা ব্যবহার করে জঙ্গলকে রক্ষা করতে। মানস এর কোর অঞ্চলের প্রায় দুশো বর্গকিলোমিটার এলাকা এরাই পাহারা দেয়। সরকার কিছু কর্মী দিলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। তাই বিতর্ক থাকলেও এদের উপস্থিতি মেনে নিয়েছে সরকার। হাতে হাতে ফলও মিলেছে। একটা পরিসংখ্যান দিলেই পরিস্কার হবে বিষয়টা।

যে বছর আলফার জন্ম, সে বছর মানসে বাঘের সংখ্যা ছিল ৬৯টি। পরবর্তী ৫ বছরে যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২৩টিতে। এরপর জঙ্গী আন্দোলন বাড়তে থাকে। জন্ম হয় বোড়ো আন্দোলনের। ১৯৮৯-এ তার প্রভাব চোখে পড়ে বাঘের সংখ্যায়। কমে দাঁড়ায় ৯২-এ। ৪ বছর পর যে সংখ্যাটা আরও কমে ৮১তে নেমে আসে। যথেচ্ছ গাছ কাটা আর চোরা শিকারের রমরমা তখন গোটা মানস জুড়ে। বাধ্য হয়ে ইউনেস্কো মানসকে বিপজ্জনক অবস্থায় থাকা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট-এর তালিকাভুক্ত করে। সেই ১৯৯৩-এ সরকার বিএসি-র দাবী মেনে নেয়। বোড়োদের একটা বড় অংশ জঙ্গী আন্দোলন থেকে সরে আসে। তখনই শুরু হয় নতুন আন্দোলন। সংরক্ষণ আন্দোলন। ফলও মেলে হাতেনাতে। ৯৫-এ বাঘের সংখ্যা বেড়ে হয় ৯৪টি, ২০০১-এ ৯৮টিতে পৌঁছয়। ২০০৩ এ প্রতিষ্ঠিত হয় মাওজিগেন্দ্রি সোসাইটি। বোড়োদের ভূমিকার এই পরিবর্তনে অবশেষে ইউনেস্কো-ও স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ২০১১-এ বিপজ্জনক তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় মানসকে। অসম-এর সংরক্ষণ আন্দোলন আজ রূপান্তরিত একটি দর্শনে। যা নতুন করে প্রাণ দিয়েছে এই অঞ্চলের ডুয়ার্সকে। হ্যাঁ, এখনও এনডিএফবি(এস) নামধারী একটি গোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন জঙ্গী কার্যকলাপ চালাচ্ছে, কিন্তু বোড়োদের একটা বড় অংশ তাদের বিরুদ্ধে।

গেলাম মাওজিগেন্দ্রি সোসাইটি পরিচালিত ট্যুরিস্ট লজ দেখতে। জঙ্গলের কোল ঘেঁষে এর অবস্থান। জানা গেল মাওজি মানে বিড়াল আর গেন্দ্রি মানে পেট মোটা বা অন্তসত্তা। ফার্টিলিটি বোঝাতেই সোসাইটির এই নাম। সম্ভবত গন্ডারের পেটমোটা গড়নের জন্যই তাকে গেন্দ্রি বা গেন্দি বলা হয়। গন্ডার শব্দটার সঙ্গেও এই মানে যুক্ত থাকলে অবাক হব না। এরপর ঢুকলাম জঙ্গলে। হেওয়ালি ফরেস্ট ক্যাম্প। এমইটিসি, বিটিসি আর বনদফতর যৌথ উদ্যোগে জঙ্গল পাহারার জন্য এই ক্যাম্পটি রাখা হয়েছে। জঙ্গলের এই অংশের গাছপালার প্রকৃতিতে বেশ অবাক হলাম। উল্টাপানির উল্টো একদম। সেখানে ছিল বড় গাছের আধিক্য আর এখানে ঝোপঝাড় বেশি। রাজদা জানাল রেন ফরেস্ট না হলেও উল্টাপানি অঞ্চলে রেন ফরেস্টের প্রায় সব প্রজাতির গাছ পাওয়া যায়। গাছের পরিসংখ্যান দেখে তো চোখ কপালে। মোট ৪৫৯ ধরনের গাছ পাওয়া যায় এই জঙ্গলে! যার মধ্যে ৮৯ ধরনের বৃক্ষ, ৪৯ ধরনের বড় ঝোপ, ৩৭ রকমের ছোটো ঝোপ, ১৭২ প্রকারের ভেষজ, ৩৬ প্রজাতির লতানে গাছ, ১৫ রকমের অর্কিড, ১৮ রকমের ফার্ন আর ৪৩ প্রকারের ঘাস পাওয়া যায় মানস বায়োস্ফিয়ারে! বাপরে বাপ!

জঙ্গলেই সন্ধে নামে। চন্দ্রকান্ত, বিরখাং-দা আর জঙ্গল ক্যাম্পের রক্ষীদের থেকে বিদায় নিয়ে আবার শুরু হল আমাদের চলা। এবার গন্তব্য মানসের মধ্য রেঞ্জ বাঁশবাড়ির উদ্দেশে। সাধারনত পর্যটকরা মানস বলতে এই অংশটাতেই আসেন এবং এই বিশাল জঙ্গলের মাত্র ১৬ কিলোমিটার ঘুরে দেখেই চলে যান। রাতের অন্ধকারে জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামগুলির মধ্যে দিয়েই চলল গাড়ি। প্রায়  রাত নাট নাগাদ পৌঁছলাম গন্তব্যে। চা বাগানের মধ্যেই বিরিনা ট্যুরিস্ট লজ। কোনো কালে অফিসার্স বাঙলো ছিল। বোড়ো আন্দোলনের জেরে যখন চা বাগান পরিত্যক্ত হয়ে যায় তখন চৌধুরিদা লিজে নিয়ে তাকে দিব্যি রিসর্টে পরিণত করেছেন। এখন অবশ্য রিসর্ট সহ চা বাগনও চালু। এটাই আপাতত আমাদের দু রাতের ঠিকানা।

 

আকৌ আহিম

ভোরে বৃষ্টির আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। বাইরে এসে বসলাম। বৃষ্টির তেজ এখন কম। বাগানে কাজে যাচ্ছে নারী পুরুষ নির্বিশেষে বাগানিয়ার দল। এরা এখন আর কেউ আলাদা ভাবে সাঁওতাল, ওঁরাও বা মুন্ডা নয়। এরা আজ অসম দেশের বাগানিয়া। এখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে দিব্যি মিশে গিয়েছে। তাই ‘ছাতা ধর হে দেওড়া…’, আজ অনায়াসেই অসমিয়া ঝুমুর-এর স্বীকৃতি পায়। আবার এক সময় এদের স্বপ্ন ‘চল মিনি আসাম যাবি…’ যখন স্বপ্ন ভঙ্গের গাথায় পরিণত হয় ‘… বাবু বলে কাম কাম, সাহেব বলে ধরি আন, সর্দার বলে লিব পিঠের চাম, ও যদুরাম, ফাঁকি দিয়া পঠাইলি আসাম…’, সেই গানও অনায়াসে শোভা পায় অসমিয়া লোকশিল্পির কন্ঠে।

জলখাবার খেয়ে ঠিক হল আজ পায়ে হেঁটেই বের হব। দুপুরেও কোনো গ্রামে যা পাওয়া যায় তাই খাওয়া হবে। বনে এসে একটু বন্য হওয়া। এই অঞ্চলটা অসমের বকসা বা বাকসা জেলায় পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্সেও বকসা নামের টাইগার রিসার্ভ আর জায়গা আছে। কিন্তু এত কাছাকাছি একই নামের দুটো জায়গার কারন কি? আবার ত্রাতার ভুমিকায় রাজদা।

একটা মত বলে এই দু জায়গাতেই ব্রিটিশরা সম্ভবত চায়ের পেটি রাখার গুদাম বানিয়েছিল। সেই বাক্স থেকে বক্সা। তবে অন্য ব্যাখ্যাটা বেশি যুক্তিগ্রাহ্য। স্থানীয় ভাষায় সা মানে আছে। আর বাক হল বাঘ-এর অপভ্রংশ। বাঘ সা অর্থাত এখানে বাঘ আছে। সেই বাঘ সা-ই কালে দিনে বাকসা বা বকসা হয়ে গিয়েছে।

চা বাগান ধরে হেঁটে আমরা পৌঁছলাম একেবারে অরণ্যের ধারে। রাজদা সতর্ক করে দিল। যেন চোখ কান খুলে চলি। বলা যায় না, কারো দর্শন মিলতে পারে। জঙ্গলকে ডানদিকে নিয়ে খানিক দূর যাওয়ার পর পাশাপাশি তিনটে রিসর্ট পড়ল বাঁদিকে। তার শেষের রিসর্টটায় ঢুকলাম। মানসের অন্যতম বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি ফ্লোরিকান-এর নামে রিসর্টের নাম। ফ্লোরিকান কটেজ। যেটি চালায় মিউজ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। মিউজ অর্থাত্‌ মানস এভার ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। আলাপ হল বর্মন ভাই, টুটু ভাইদের সঙ্গে। রাজদা শুধু পূর্ব পরিচিতই নয় বহুবার ঘুরে গিয়েছে। এরাও সংরক্ষণের কাজই করে। তবে এরা মিক্সড কমিউনিটি। রাভা, বোড়ো, রাজবংশী, নেপালি বিভিন্ন প্রজাতির মানুষ মিলে একসঙ্গে আন্দোলনটা চালাচ্ছে। ২০০৩ সাল থেকে এরা রেজিস্টার্ড। সংরক্ষণ আন্দোলনকে চালিয়ে নিয়ে যেতেই পর্যটনের ব্যবসা শুরু। ২৪ জনের এক্সিকিউটিভ কমিটি আজ কমে ৯ জনে এসে দাঁড়ালেও এদের কর্মকান্ড কিন্তু সফল। শুধু এই রিসর্টের বার্ষিক টার্ন ওভার ৩৫ লাখ টাকা ছুঁয়েছে! রিসর্টের জমি সহ মালিকানা অংশিদারী ভিত্তিতে সদস্যদের মধ্যে আইনি ভাবে বন্টিত! পর্যটনের বাইরে গ্রামের মানুষের উন্নতির জন্য কাজ করছে এরা। সোলার লাইট লাগানো, ছোটোদের স্কুলমুখি করা, বেকারদের জঙ্গল সাফারির কাজে এগিয়ে আসতে উত্‌সাহ দেওয়া প্রভৃতি একগুচ্ছ কর্মকান্ড! টুটু ভাই-এর উপর পর্যটনের পুরো দায়িত্ব। ঋষিকেশ থেকে রিভার rafting-এ প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে। পর্যটকদের raft-এ করে মানস নদীতে সাইট সিইং-এ নিয়ে যায়। যে নদীর দুপাশে ঘন জঙ্গল। মানসের কোর এরিয়া।

খানিক আড্ডা মেরে, চা খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। জঙ্গলের পাশ দিয়ে হাঁটতে বেশ লাগছিল। তার মধ্যে মেঘলা আকাশ আর হাওয়ার জন্য কষ্টও ছিল না বিশেষ। মানসে প্রায় ৬০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে! গোটা দেশের কোনো জঙ্গলে যা নেই! এর মধ্যে ২২টি প্রজাতি বিলুপ্তপ্রায় শ্রেণীর। একমাত্র এখানেই পাওয়া যায় গোটা ভারতের সব থেকে বিশুদ্ধ প্রজাতির বন্য মহিষ। এছাড়াও আছে ৪২ প্রজাতির সরীসৃপ, ৭ প্রকারের উভচর এবং ৫০০ প্রজাতির পাখি! যার মধ্যে বিশ্বজুড়ে বিলুপ্তপ্রায় ২৬ প্রজাতির পাখিও সামিল। মনে মনে ভাবি ইশ্‌শ্‌ তখন যদি ইউনেস্কোর প্রস্তাব মেনে নিত আমাদের রাজ্য সরকার তাহলে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্স, অসমের ডুয়ার্স আর ভুটানের জঙ্গল মিলে এক সুবিশাল অরণ্য থাকতো বিশ্বের এই অঞ্চলে। আশির দশকে ইউনেস্কো প্রস্তাব দেয় জলদাপাড়া, গরুমারা সহ উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চল সংলগ্ন গ্রামগুলিকে সরিয়ে তাদের পুনর্বাসনের। যাতে একটি অবিচ্ছিন্ন ফরেস্ট করিডোর তৈরি হয়। কিন্তু যে কোনো কারনেই হোক তত্‌কালীন রাজ্য সরকার এ প্রস্তাব মানেনি!

হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছলাম নদীর ধারে। সম্প্রতি এই নদীই ভাসিয়েছে জঙ্গল আর লোকালয়। জল কমলেও নদী যেন ফুঁসছে এখনও। বেকি-মানস। উত্তর দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে বেকি আর মানস নদীর সঙ্গমস্থল। মিলনের পর সে যেন আরও রুদ্র। সাম্প্রতিক বন্যার সময় এই নদীই জঙ্গলের খানিকটা খেয়ে নিয়েছে। যার চিহ্ন আমাদের সামনেই। নদীর রূপ দেখে বিস্ফারিত চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসার জোগাড় হল যখন দেখলাম ৮ থেকে ১০ বছরের দুটি বাচ্চা হঠাত্‌ জামা কাপড় খুলে উদোম হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীর বুকে। তারপর স্রোতের বিপরীতে কুশলি হাতের স্ট্রোকে এগিয়ে যাওয়া। এদের সঠিক পরিকাঠামোয় প্রশিক্ষণ দিলে কি এক আধটা মাইকেল ফেল্পস তৈরি হয় না! কে জানে? হঠাত্‌ চোখ গেল শুধু এ দুজনই নয়, নদীর চর থেকে দুটি ভিন্ন ভিন্ন নৌকাও ধেয়ে আসছে মাঝ বরাবর। রহস্য পরিষ্কার হয় এবার, প্রবল স্রোতে ভেসে আসছে ভাঙনে উপড়ে পড়া এক আস্ত গামার গাছ। প্রতিযোগিতা তারই দখল নেওয়ার। যে আগে ছোঁবে গাছ তার। পরে সেই গাছ বেচেই পয়সা। চোখের সামনে এক অন্য আন্দোলনে আন্দোলিত হল মন।

নদীর পাড়ে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে গিয়ে উঠলাম বেকির রোষ থেকে এক চুলের জন্যে বেঁচে যাওয়া ওয়াচ টাওয়ারে। বাঁদিকে বেকি-মানস। সামনে আর ডাইনে মানস জাতীয় উদ্যান। পিছনে গ্রাম। আর সামনে খানিক দূরে উদ্ধত হিমালয়। ভুটান। লৌকিক দেবী মনসার নাম থেকেই নদীর নাম মানস। জঙ্গলের বুক চিরে বয়ে চলা মানস নদীর নাম থেকেই মানস জাতীয় উদ্যান। কেন দেবী মনসা? না, উত্তর দিতে পারলে কোনো পুরষ্কারের ব্যবস্থা নেই।

প্রকৃতিতে এতটাই বুঁদ হয়ে ছিলাম যে রাজদা ডাকছে খেয়ালই করিনি। তারপর রাজদার হাতের ইশারা লক্ষ্য করতেই শিহরিত! নিচে একটু দূরেই সবুজে ছাওয়া জলাশয়ে একটা পূর্ণ বয়স্ক রাইনো।

মনে হতেই পারে যেখানে কাজিরাঙা, জলদাপাড়া বা গরুমারায় গেলেই হুদো হুদো রাইনো দেখা যায় সেখানে একটা রাইনো দেখেই এত উচ্ছাসের কারন কি? বিশেষত তিনজনের কেউই এই প্রথম গন্ডার দেখছি না! উচ্ছসিত হওয়ার কারন আছে বৈকি। আঠাশ’শ বর্গমাইল জঙ্গলে গন্ডারের সংখ্যা যে মাত্র ২২টি! তাও ২০০৮ এ পবিতোরা জাতীয় উদ্যান থেকে ১০টি এবং ২০১২-এ কাজিরাঙা থেকে ৪টি গন্ডার এখানে ছাড়ার পর এই সংখ্যা! অশান্ত সময়ে মানসের গন্ডার সবথেকে বেশি দুর্ভাগ্যের শিকার। চোরা শিকারীদের প্রধান টার্গেট হয়ে ওঠে ওরা। এক তো খড়গের লোভে। তার সঙ্গে আছে গন্ডারের মাংস খাওয়ার উত্‌সাহ। কারনটা একই। পৌরুষ বৃদ্ধির অন্ধ বিশ্বাস!

গন্ডারের জলকেলি দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে যায়। এবার ফেরার পালা। কাল সকালেই শিলিগুড়ি প্রত্যাবর্তন। প্রথমবারেই প্রেমে পড়েছি মানসের। তাই ছেড়ে যেতে মন চায় না। তবুও ঘরে যে ফিরতেই হবে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে নামবার আগে তাই মানসের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে অঙ্গীকার করি, ‘আকৌ আহিম, মানখ্‌, আকৌ আহিম’ (আবার আসবো, মানস, আবার আসবো)।

2 thoughts on “অন্য ডুয়ার্স

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান