সোনকুপির পলাশোত্সব

কুকুবুরু। মুরগি পাহাড়। মুরগি টিলা বললেই মানায় বেশি। দাঁড়ানো মুরগি যেমন সামনে ছড়ায় দুই ডানা, অবিকল সেই ভঙ্গীতেই। সামনে ছড়ানো ছেটানো পলাশ গাছের দল। মাথায় মোরোগের ঝুঁটির মতন থোকা থোকা পলাশ।

দোলের দিন তিনেক আগে হঠাত্‌ই স্যান্ডির ফোন। চলে আয় বাঘমুন্ডি, একটু অন্যরকম দোল খেলতে। লেখার রসদও মিলবে। কাঙালকে শাকের ক্ষেত দেখানোর অপেক্ষা মাত্র। স্যান্ডি। সন্দীপন চক্রবর্তী। একসময়ের সহকর্মী। এখন পর্যটন ব্যবসায়। বরুনদেব ভট্টাচার্যকে সঙ্গী করে বানিয়ে ফেলেছে বুগিয়াল। সেই বুগিয়ালেরই প্রথম উদ্যোগ সোনকুপি বানজারা ক্যাম্প। দোল উপলক্ষে আমন্ত্রণ।

রাতের আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার সবচেয়ে ভাল। রাতে চড়ে পরদিন সকাল সাতটায় নামা যায় বরাভূম স্টেশনে। কিন্তু একদিনের নোটিশে রিজার্ভেশন অমিল। তাই সাব্যস্ত হল ভোর ৬টা ২৫ এর রূপসী বাঙলা এক্সপ্রেস। সাড়ে চারটের অ্যালার্মও রেডি। কিন্ত শুরু থেকেই বিপত্তি। কোন মায়াজালে সাড়ে চারটের অ্যালার্ম সকাল ছ’টায় বাজে বোধগম্য হল না। দ্রুত তৈরি হয়ে শালিমার স্টেশন। গুগল-বাবা জানালেন সকাল ছ’টা তিপ্পান্নয় পুরুলিয়া যাওয়ার আর একটি এক্সপ্রেস মিলবে। হায় রে কপাল! ছ’টা চল্লিশে পৌঁছে টিকিট কাটতে না কাটতে সে ট্রেনও পগারপাড়। এটা কি হল! তেরো মিনিট বিফোর টাইম কেন? উত্তর দিলেন কাউন্টার ক্লার্ক। পরিবর্তিত হয়েছে সময়। তাহলে উপায়? সাতটা পঁয়তাল্লিশে আরণ্যক আছে। কিন্তু তাতে গেলে আদ্রায় নামতে হবে। অন্য সময় হলে ধুত্তোরি বলে হয়তো ফেরার পথ ধরতাম, কিন্তু জেদ চেপে গেছে মাথায়, যেতেই হবে। অতএব আরণ্যক-ই হোক।

বেলা প্রায় সাড়ে বারোটায় আদ্রা। পাশের প্লাটফর্মেই মেমু দাঁড়িয়ে। তখন-ই ছাড়বে। গন্তব্য পুরুলিয়া। ব্যাস আর পায় কে? পুরুলিয়া পৌঁছে দুপুরের খাওয়া সারা যাবে। কিন্তু পৌঁছতেই বাস স্ট্যান্ড যাওয়ার টোটো মিলে গেল। বেশ, একটু পরেই হবে না হয়। স্ট্যান্ডে ঢুকতেই চোখে পড়ে বাঘমুন্ডির বাস তখন-ই ছাড়ছে। ওদিক পানেই যাব শুনে কন্ডাক্টর প্রায় চ্যাংদোলা করে তুলে নেয় আর কি। কিন্ত জায়গা নেই যে? মুখের কথা শুধু খসার অপেক্ষা। সব থেকে প্রিমিয়াম ডবল সিটের জানালার ধার থেকে সটান তুলে দিল এক ভদ্রলোককে!

  • আরে আরে করেন কী?
  • আপনি বসেন স্যার এদের সব অভ্যাস আছে।

সে প্যাসেঞ্জারটিও নির্বিকার। যেন কিচ্ছু হয়নি। একটা জটিল অঙ্ক মাথায় ঢুকলো। সৌজন্য ইজ ডাইরেক্টলি প্রোপোর্শনেট টু নিজের সুবিধে বোধ! শহর কলকাতা হলে এ সুযোগ নেওয়া যেত না আর সে ভদ্রলোকও সুবোধ বালকটি হতেন না।

স্যান্ডির ফোন। কতদূর? বাসে আছি জেনে বলে দিল কোথায় নামতে হবে। নামতে হবে দুয়ার্সিনি। বলে কি? সেতো ঝাড়খন্ডে!!! গালুডির কাছাকাছি। বাঘমুন্ডির কাছে দুয়ার্সিনি কোথা থেকে আসে?

কন্ডাক্টরকে জানাতে সে বেচারা আমারই মতন দিশেহারা। অবশেষে উদ্ধার করলেন সংলগ্ন আসনে বসা এক আদিবাসী বৃদ্ধা। জানা গেল জায়গার নাম আসলে সোনকুপি। বাস স্টপ-এর নাম দুয়ার্সিনি মোড়। আমার এই সহযাত্রিনীকে অনেকক্ষন থেকেই নজর করছিলাম। বাসে বসা ইস্তক নিয়ম করে ১০ মিনিট অন্তর চোখে নানান ওষুধ ঢেলে চলেছেন। বোঝা গেল শহরে চোখের ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছেন। ভীষণ মিতবাক। দেড় ঘন্টার যাত্রাপথে মাত্র তিনটি শব্দ। খুলে দাও (ওনার একটি চোখের ওষুধের ভায়েল), সোনকুপি (দুয়ার্সিনি প্রসঙ্গে) আর নামো (অর্থাত্‌ দুয়ার্সিনি মোড় পৌঁছেছে বাস)।

আগমন সংবাদ দেওয়া হল স্যান্ডিকে। বেলা প্রায় সাড়ে তিনটে। পেতে পেতে খিদে মরে গিয়েছে। মূর্তিমান ভগ্নদূতের মতন বাইকে চড়ে স্যান্ডির আগমন। খাবারের কোনো ব্যবস্থা এখনও হয়নি। পরদিন সকাল থেকে হেঁশেল খুলবে সোনকুপি বানজারা ক্যাম্পের। তাহলে উপায়? বিস্কিট। আর রাতে? একজনের বাড়ি থেকে আসবে। অগত্যা।

বাইকে সওয়ার হয়ে আরও কিলোমিটার দেড়েক। স্থানীয় স্কুল মাঠ পার করেই শিমূল পলাশের জঙ্গল। তার মধ্যেই লাল মাটির উঁচুনিচু পথ। কয়েকটা ডান দিক আর বাম দিক ঘোরার পর হঠাত্‌ ম্যাজিক। জঙ্গলের মাঝে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে মায়াবী বাগান। কোনো স্বার্থপর দৈত্যের নয়। সোনকুপি বানজারা ক্যাম্পের। এখানে সবার আমন্ত্রণ। এখানে শীত শেষে বসন্তের আগমন। এখানে পলাশের লালিমায় পথের ক্লান্তিমোচন। যার দুধারে সার সার তাঁবু দন্ডায়মান।

পুরোটাই জঙ্গল ছিল। তিন মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে বুগিয়াল আর তাদের তিন নম্বর সাথী স্থানীয় সুজিতের নেতৃত্বে নন্দন কানন সেজে উঠেছে। এই তিন মাস স্থানীয় মানুষের রোজগার এর সংস্থানও হয়েছে। মোট কথা সবাই মিলে একটা যাচ্ছেতাই কান্ড ঘটিয়ে ছেড়েছে। টেনিদা থাকলে নিশ্চয় এটাকে পুঁদিচ্চেরি ব্যাপার বলে মেনে নিতেন।

তাঁবুগুলোর সঙ্গে টয়লেটের ব্যবস্থাও আছে। আছে ভিতরে খাট বিছানা আর এয়ার কুলার। খাট ছাড়া তাঁবুও পাওয়া যাবে। চার্জ একটু কম। আর বেসিক সিঙ্গল তাঁবুও আছে। জঙ্গলের ধার ঘেঁষা তেমনই এক তাঁবুর দখল নিলাম।

  • ভাই একটু খাটাব।

স্যান্ডির আব্দার। কী কাজ? বিশেষ কিছু না। গামছার পেল্লায় থান থেকে মাপ মতন কেটে শ-খানেক গামছা বের করতে হবে। পরদিন অতিথিদের উপহার। শুধু গামছা নয়। সঙ্গে একটা করে ছোটো টর্চ। আর পরিবার বা দল পিছু বিশেষ ভাবে তৈরি মাটির জলের বোতল।

পর্ণমোচনের পর জঙ্গল সাফ করতে শুকনো পাতায় আগুন দেওয়া হয়েছিল। তার ধোঁওয়া অনেকক্ষণ থেকেই চোখে পড়ছিল। বেলা গড়াতে এক সৌন্দর্য উন্মোচিত হল। আঁধার হয়। পাহাড়ের শিরা উপশিরায় আগুনের আঁকিবুকি উজ্বল হয়। তার সাথেই ঠিক পাহাড়ের মাথায় রূপোর থালার মতন চন্দ্রোদয়। স্বর্গীয় দৃশ্য। যদিও দৃশ্যটা ভয়ঙ্কর সুন্দর। জঙ্গলের ছোট ছোট প্রাণীদের জন্য প্রাণ বিদারক।

সব অতিথি পরদিন আসবেন। তবে সেদিনই সকালে আমার আগেই দুই অসমবয়সী বন্ধু হাজির হয়েছেন। তুলনামূলক কম বয়স্ক জন অরিন্দমদা, সঙ্গী ৭৮ বছর বয়সী আঙ্কল। নাম জানার দরকার হয়নি। একজনের শখ ছবি তোলা অন্যজনের বই পড়া। দুজনের একটি কমন শখ আছে জানা গেল রাতে। দুজনে পিছন দিকের জঙ্গল প্রান্তের তাঁবুতে নিরিবিলির খোঁজে।

রাত বাড়ে। রূপোলি থালা তখন মাথার উপর। গ্লাসের সোনালি তরল ঝিম ধরায়। যেমন ধরায় নিশি-প্রকৃতি। আঙ্কলদের তাঁবু থেকে ভেসে আসে দরবারীর আলাপ। খুব মৃদু তানে। আবহে যোগ করে অন্য মাত্রা। সোনকুপি বানজারা ক্যাম্প পূর্ণতা পায়। সুরের সঙ্গতে সুরার ক্রিয়াশক্তি হয় গভীরতর। অবশ হয় চেতনা।

কুহুতানে সোনালি আলো গড়িয়ে পড়ে কুকুবুরুর মাথায়। শিরশিরে হাওয়ার কাঁপুনি নিয়ে তাঁবু ছাড়তেই অন্যরকম মুগ্ধতা গ্রাস করে। কুকুবুরুর সারা অঙ্গে সোনাঝরা চাদর। হাওয়ার দোলায় লুটিয়ে পড়ে পলাশ, শিমূলের দল। লোকলস্কর নিয়ে স্যান্ডির সাজোসাজো রব। আমায় দেখেই যেন হাতে পায় বসন্ত পূর্ণিমার চাঁদ। গোটা তিরিশেক বিছানায় তখনও বেড শিট পাতা আর পিলোকভার পরানো বাকি। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আসতে শুরু করে দেবেন অতিথিরা। অগত্যা।

প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে পলাশতলায় সবে গাটা এলানো, ধেয়ে এলো দ্বিতীয় নির্দেশ।

  • ভাই অতিথি আপ্যায়নের ভারটা তুই নে।
  • মানে?
  • মানে গলায় গামছা আর হাতে টর্চ তুলে দিতে হবে।
  • ওরে চুপ কর। একি সাঙ্ঘাতিক কথা!
  • কেন ভূল কী বললাম?

তর্ক জোড়ে স্যান্ডি।

  • ভূল নয়? অতিথি পৌঁছতেই গলায় গামছা!!! আর কেউ আসবে? তবে হাতে হ্যারিকেনের বদলে টর্চ ধরালে হয়তো রি-কনসিডার করতেও পারে।
  • সাংবাদিকদের স্বভাবই কথায় প্যাঁচ খোঁজা।

আমার অট্টহাসি থামিয়ে গোমড়া মুখে আত্মসমর্পন করে ও। আশ্বস্ত করি হুকুম তামিল হবে।

স্নান সেরে তৈরি হওয়ার আগেই প্রথম দল ঢুকে পড়ে। তরিঘরি অতিথি আপ্যায়নে মন দিতে হয়। আমার তাঁবুটা তখন গোদাম-তাঁবু। শত খানেক গামছা আর বাক্স বাক্স টর্চে নিজের অস্তিস্ব সংকট।

সব মিলিয়ে গোটা পাঁচেক দল। মোট অভ্যাগত ছোটো-বড় মিলিয়ে প্রায় ষাট। নিমেশে জনমুখর হয়ে উঠল সোনকুপি বানজারা ক্যাম্প।

 

অভ্যাগতদের প্রাতঃরাশে বসিয়ে স্যান্ডির নির্দেশে ওর বাইকে সওয়ার হই। যেতে হবে বাঘমুন্ডি। কিছু জরুরী জিনিষ নেওয়ার আছে। সেখানেই দেখা প্রেমাশিষদা-দের সঙ্গে। বাঘমুন্ডিতেই উঠেছে। তবে সারাদিন কাটাবে ক্যাম্পেই। সঙ্গে সুস্মিতাদি (বৌদি), গৌতমদা আর বাবলা। বাঁচা গেল। এত অপরিচিতের মধ্যে অন্তত পূর্বপরিচিতদের সঙ্গে কাটানো যাবে।

ফেরার পথে স্যান্ডি জানাল ক্যাম্পে ঢোকা হবে অন্য পথে। একটা জাঙ্গল ট্রেল হবে বাইক নিয়ে। শুনেই শিহরণ। পাকা রাস্তা ছেড়ে সোনকুপি গ্রামের বুক চিরে জঙ্গলের উপকণ্ঠে গতিরুদ্ধ হল বাইকের। স্যান্ডির চাপা কিন্তু উত্তেজিত ইশারা, ‘বাঁদিকের ক্ষেতে দেখ’।

  • কী?
  • ভোলাবাবার চরণচিহ্ন। খবরদার গেস্টরা যেন না জানতে পারে। আর তোর লেখাতেও এর উল্লেখ করবি না।
  • মানেটা কি? এতো অন্তত চার-পাঁচ দিন আগেকার পাগমার্ক। আর সবাই জানে এই অঞ্চলটা দলমা-চান্ডিল রুটের এলিফ্যান্ট করিডোর।

 

ইতস্তত সবুজের মাঝে রুক্ষ লাল মাটি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দ্বীপসদৃশ পলাশগাছগুলিকে ঘিরে প্রাণের স্পন্দন। যেন ভেসে ওঠা দ্বীপে সভ্যতার উন্মেষ। আসলে বিভিন্ন দলে বিভক্ত অতিথিরা নিজেদের মতন করে এক একটা গাছের ছায়া দখল করেছেন। রাতে যতই শীতের আমেজ থাক রোদ চড়লে ‘রবি’ ঠাকুর হয়ে যান। মানে ‘সোলার কুকার’ আরকি? সুর্যস্নাত সব কিছুই তখন ‘বেক্ড’ হতে শুরু করে। কিন্তু ছায়ায় দাঁড়ালেই শান্তি। তাই এই ছায়া দখল।

চটজলদি পেটে কিছু গুঁজে প্রেমাশিষদা-দের আড্ডায়। ওরা কখন যেন পৌঁছে আসর জমিয়ে বসেছে। কাছাকাছি দুটি পলাশ গাছে বাঁধা হ্যামক-এ সুস্মিতাদি, গৌতমদার গলায় অখিলবন্ধু, গিটারে সঙ্গত বাবলার আর প্রেমাশিষদা সাকির ভূমিকায়। বর্ণহীন রাশিয়ান তরলে বর্ণহীন সফ্ট-ড্রিঙ্ক মিশিয়ে হাতে হাতে পরিবেশনে ব্যাস্ত। আমারও জুটল।

“…যেন কিছু মনে কোরো না, কেউ যদি কিছু বলে…”

অখিলবন্ধুই সংশয় ঘুচিয়ে দিলেন। ঠান্ডা পানীয়ে চুমুক দিতে…

“…কত কিই সয়ে যেতে হয়…”

আপাতত রোদ সওয়ানোটাই চ্যালেঞ্জ। তবে রোদের সাধ্য কি সুর ও সুরার সঙ্গমে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

 

দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর আলাপ হল তিনজনের একটি দলের সঙ্গে। বাবা, মা, মেয়ে। মাঝেমাঝেই বেরিয়ে পড়েন। যেমন এবার। মেয়ে শ্রীজা অবশ্য একা ঘুরতেই স্বচ্ছন্দ বেশি। পরিচয়ের পর সটান আব্দার চলুন জঙ্গলে ঘুরে আসি। অনেক কষ্টে নিরস্ত করা যায় তাকে। ঠিক হয় রোদ একটু পড়লে বের হওয়া যাবে।

যাঁদের তাঁবুতে এয়ারকুলার তাঁরা প্রায় সকলেই ভাত ঘুমের আশায় স্ব-তাঁবু মুখী। আর যাঁদের সে সুখ জোটেনি তাঁরা আবার পলাশের আশ্রয়ে। আমি তথৈবচ।

বিকেলে যুবতী সঙ্গীনী শ্রীজার সমবিভ্যাহারে অরণ্য ভ্রমণ। কথারা ছুটি নিয়েছে। হাওয়ারা ব্যাস্ত বুনো গন্ধ পরিবেশনে। রোদ নেতিয়ে পড়েছে ক্লান্তিতে। পাখিদের গান আর শুকনো পাতায় ওঠা মর্মরধ্বনি এক ভাললাগা আবহের সৃষ্টি করে। হাঁটতে ভাল লাগে। মন প্রলুব্ধ হয়। ছোঁওয়া পেতে, ছোঁওয়া দিতে। সময় গড়িয়ে যায়। মুহুর্তরা মনের মণিকোঠায় মসৃণ মায়াময়। তবে আলো পড়ার আগেই ক্যাম্পে ফিরতে হবে। সঙ্গে টর্চ নেই। তাছাড়া বুড়ির ঘর পোড়ানোর আয়োজন আছে যে।

বুড়ির ঘর পোড়ানো অথবা হোলিকা দহন নাকি ছোটোবেলা থেকে শোনা চ্যাঁচোর! নামে তো সত্যিই কিছু আসে যায় না। স্যান্ডি নিপুন তত্‌পরতায় আয়োজন করেছে প্রায় নিখুঁত। প্রায়টা কেন, বোঝা গেল দহন শেষে।

আজও কুকুবুরুর মাথা ছাড়িয়ে রূপোলি থালার আত্মপ্রকাশ। সমবেত অতিথিরা বুড়ির ঘর ঘিরে উপবিষ্ট। অতিথিদেরই এক খুদের হাত দিয়ে বুড়ির ঘরে অগ্নিসংযোজিত হল। নিমেষে আগুন আকাশছোঁওয়া। পরমুহুর্তেই সব শেষ। হতচকিত অতিথির দল। প্রথমে গুনগুন তারপর কোলাহল।

  • একি এতো জ্বলার আগেই শেষ!
  • এটা একটা চ্যাঁচোর হল!!
  • ভিতরে আলু, বেগুন দেওয়া হয়নি পোড়ানোর জন্য?
  • স্যান্ডি কোথায়, স্যান্ডি?
  • এটা কি করলি বাবা?
  • এতো বহ্বারম্ভে লঘু ক্রিয়া!!!

হাঁকডাক, হইচই, হাসি আর খিল্লি। স্যান্ডি হাওয়া। হঠাত্‌ তার মধ্যেই স্বনাম শুনে ঘাবড়ে যেতে হয়। সব ব্যাটাকে ছেড়ে দিয়ে এই ব্যাটাকেই ধর। সকালে আপ্যায়ন করার দাম। তবে এই হাসি তামাশায় হঠাত্‌ই দ্বীপগুলো একটা দেশে পরিণত হয়। বহুদলীয় ব্যবস্থা ভেঙে একদলীয় ব্যবস্থার সূত্রপাত। গণতন্ত্রের জন্য তা স্বাস্থ্যকর না হলেও সোনকুপি বানাজারা ক্যাম্পের জন্য লাভদায়ক হল। আলাপ হল সবিতা, শ্যামলী, মীরা, শমিতা, লুপিতা, রাজু, কল্যাণ, রাহুল, রতন, মহেন্দ্রবাবু, জয়দেববাবুদের সঙ্গে। নিমেষে বিশালায়তন আড্ডাখানা। এরমধ্যে শমিতার মাধ্যমে ভগিনী লাভ একটা মস্ত পাওয়া।

একটা দলে পরিবর্তিত হলেও আড্ডা বসে তিন-চারটে আলাদা টেবিল ঘিরে। তবে মিলিয়ে মিশিয়ে। মীরার কন্যার গলাটি সরেস। সুরের বাতাস বইয়ে দেয় পলাশের গন্ধ মাখিয়ে। রাতেও চলে সুর-সুরার যুগলবন্দী। যার যাতে রুচি। আমি আমন্ত্রিত রাহুলদের টেবিলে। সেখান থেকেই নজরে আসে গোটা সোনকুপি বানজারা ক্যাম্পের রাতের নজারা। অতিথিরা এই প্রাকৃতিক কোলাজে হয়তো বা অনেকেই প্রগলভ।

 

বাইরে বের হলেই আমার ঘুম ভাঙে আলো ফোটার সাথে সাথে। এদিনও ব্যাতিক্রম নয়। অনেকেই উঠেছেন। ঠান্ডা হাওয়ার পরশে গায়ের চাদরটা টেনে নিতে নিতে চলছে বাসি মুখে আড্ডা। দফায় দফায় পরিবেশিত হয় গরম চা। দুধ ছাড়া। যাঁদের শর্করায় আপত্তি বঞ্চিত নন তাঁরাও। প্রমীলা বাহিনী দল বেঁধে মালাকারের ভুমিকায়। প্রচুর পলাশ জোগাড় হয়েছে। মালা গাঁথা চলছে আর চলছে ফোটোশ্যুট, কখনও বা সেল্ফি আর গ্রুপি (Self থেকে যদি Selfie হয়, তবে Group থেকে কেন Groupie নয়!! তাই গ্রুপফি না বলাই সাব্যস্ত হল)।

আগের রাতেই হাজির হয়েছিলেন বন্ধুবর গৌতম দাস বাউল ও সম্প্রদায়। তাঁরা এই পাঁচ সকালেই প্রস্তুত। তখনও যাঁরা তাঁবুর অন্তরালে তাঁদের ঘুম ভাঙল দরাজ প্রভাতির সুরের অনুরণনে। পলাশোত্‌সবের আবহটা বাঁধা হয়ে গেল যেন সেখানেই। আগেই বলা হয়েছিল কেউ যেন রঙ না আনেন। উদ্যোক্তারাই ভেষজ পদ্ধতিতে তৈরি ফুলেল আবীরের বন্দোবস্ত করেছিলেন। সেই আবীরেই রঙ খেলা।

সব থেকে ভাল লাগল দেখে শুধু সোনকুপির অতিথিরাই নন, বাঘমুন্ডি বা আশপাশের বিভিন্ন রিসোর্টে ছুটি কাটাতে আসা সব অতিথিদেরই ছিল পলাশোত্সবের আমন্ত্রণ সোনকুপি বানজারা ক্যাম্পে। তাঁরা এলেনও সবাই। নিমেষে আত্মীয়তা গড়ে উঠল কয়েক ঘন্টা আগেও যাঁরা একে অপরকে চিনতেন না তাঁদের মধ্যে। যেন যুগ যুগান্ত থেকে এভাবেই হোলি খেলতে অভ্যস্ত সবাই। কেউ হয়তো শান্তিনিকেতনের কথা বলবেন, কিন্তু ভেবে দেখুন প্রেক্ষিতে আছে আসমান-জমিন ফারাক। ধন্যবাদটা তাই স্যান্ডি আর বরুণেরই প্রাপ্য।

এর পরের কথন সামান্যই। বাউলের মধুরতা, আবীরের মেদুরতা আর মহুয়ার মদীরতায় পলাশোত্সব আবিষ্ট করে উপস্থিত অতিথিদের। তখনই শপথবাক্য পাঠ হয়ে যায় সোচ্চারে, “…আসছে বছর আবার হবে…”। কুকুবুরুর পাদদেশে পরের বসন্তের আগমনীনামা লিখিত হয় সকলের অলক্ষ্যে।

 

হাওড়া থেকে রাতের আদ্রাচক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারই ভাল সকাল সাতটা নাগাদ পৌঁছে দেবে বরাভূম স্টেশনে যানবাহন মিলবে না হলে স্যান্ডিরাই ব্যবস্থা করে দেবে

সোনকুপি ক্যাম্পে জন দিন প্রতি আহারাদি সহ খরচ ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে যোগাযোগসন্দীপন চক্রবর্তী +৯১৯৮৩০০৬৩৬৪৩

  (ছবিলেখক)

পঞ্চম পথিক

ছোট ছোট টিলা। রুক্ষ লাল আর ধুসর সবুজের কোলাজে। বুক চিরে জাতীয় সড়ক পাঁচ এর হারিয়ে যাওয়া। তার ঠিক পাশেই ছোট্ট ছিমছাম রেল স্টেশন, বালুগাঁও। সকালের নরম রোদে সিক্ত। খানিক আগেই হাওড়া-চেন্নাই মেল নামিয়ে দিয়ে গেছে হাওড়া থেকে ৫২৬ কিমি দূরত্বের এই রেল স্টেশনে। তবে পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত। আধা বাঙলা আর আধা হিন্দি মিশিয়ে বিশুদ্ধ ওড়িয়া ভাষার সঙ্গে দর কষাকষি। ছ’শ না চার’শ। শেষমেস রফা সাড়ে চার’শ-য়। অটোয় আরও ৪৫ কিলোমিটার যেতে হবে যে। তবে না মিলবে গন্তব্য। মোঙ্গলাজোড়ি। ইডলি আর বড়ার ফুয়েল নিয়েই যাত্রা শুরু। যেখানে অপেক্ষা আছে চারমূর্তি। কঙ্কন বাঁড়ুজ্যে, রিন্টু মুখুজ্যে, ভিটু ভটচায আর রাজু গোঁসাই। তবে বয়সে সব থেকে ছোট হওয়ার ডিস-অ্যাডভান্টেজে চারটে নামের সঙ্গেই জুড়বে একটা করে ‘দা’। বালুগাঁও রোড পার করে এনএইচ ফাইভ। পিছন পানে যাওয়া। অর্থাত খুরদা রোড অভিমুখে। যে স্টেশন ফেলে আসা প্রায় আধ ঘন্টাটাক আগেই। চেন্নাই মেলে।

  • স্যার, একবার পুছ লেতে হ্যাঁয় মোঙ্গলাজোড়ি কা রাস্তা।

ছোট্ট জনপদ টাঙ্গিতে পৌঁছেছে গাড়ি। ওডিশার খুরদা জেলার অন্তর্গত। জনপদ ছাড়িয়েই ডাইনে পথ। সে পথে আরও কিলোমিটার তিনেক যেতেই বাঁদিক ছবির মতন ঝকঝকে রিসোর্ট, গডউইট ইকো হাট। আপাতত যাত্রা শেষ। চার অগ্রজ তখনও পৌঁছয়নি। তবে তাতে অসুবিধে হল না কোনো। প্রাতকৃত্যাদি সারতে না সারতেই হই হই রই রই।

  • নে নে গরমাগরম চা ধর।

বাথরুম থেকে বেরোতেই গরম চায়ের কাপ হাতে ধরিয়ে দেয় ভিটুদা। বোঝা যায় গাড়ি থেকেই সময় মেপে চায়ের ফরমাশ হয়েছে।

  • ভাই পঞ্চম পথিক যাও। স্যালাড, মাছভাজা কী পাওয়া যায় খোঁজ নাও।

রিন্টুদার নির্দেশ শিরোধার্য। বাইরে আসতেই নজরে পরে খোলা গেট। একটু ডাইনে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। যার এক পাশে গা জড়াজড়ি খান তিনেক টিলার। যেন হঠাত্‌ থমকে যাওয়া ঢেউ। “…কী ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে; চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে…” । বুদ্ধদেব বসু প্রভাব বিস্তার করেন মনে।

গোল আর পাতলা করে কাটা শসা, টোম্যাটো আর পেঁয়াজ। তার উপরে বুক চেরা লঙ্কারা উদোম নির্লজ্জতায়। বিট নুন, গোলমরিচ আর লেবু ছড়ানো। ব্যবস্থা দেখে চার ‘দা’-ই খুশি। তখন চড়া রোদ। মধ্য ফেব্রুয়ারিতেই মে-র প্রকোপ। ঠিক হল এখন জলবিহারী হয়ে বিকেলে রোদ পড়লে বিহঙ্গবিহারী হওয়া যাবে। কঙ্কনদার পছন্দের ব্র্যান্ড ‘স্বাক্ষর’ আর বাকিদের বরাদ্দ ‘আধিকারিকদের পছন্দ – নীল’। ক্রমেই ঘরের ভিতরের আবহ রঙীন। প্রগলভতা গ্রাস করে পাঁচ পথিককেই। হঠাত্ গান ধরে কঙ্কনদা। সঙ্গতে রাজু। তবলার অভাব মেটাচ্ছে স্যালাড সার্ভ করা রূপোলি ট্রে। সেই আওয়াজেই কিনা জানা নেই তরিঘরি রিসোর্টের রুম-সার্ভিস ট্রে নিয়ে হাওয়া।

  • রাজার বিছানা থেকে ট্রে-টা দেতো ভিটু, বাজাই।

চমকে তাকিয়ে উদ্ধার হয় ওটা ট্রে নয়। সাধের অ্যাপেলের ল্যাপটপ। নিমেষে ব্যাগে চালান করতে হয়। সুরাসিক্ত এবং সুরে আসক্ত রাজুদাকে বিশ্বাস নেই কোনো।

বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ চিলিকা বার্ড প্যারাডাইজ, টাঙ্গি রেঞ্জের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া। মূলত চিলিকা হ্রদের উত্তর প্রান্তের এই নিম্নভূমি অঞ্চলটি সাধারন ভাবে জলাভূমি। যার মধ্যে সরু সরু নালা সদৃশ ক্রিক আছে একাধিক। যা মূল হ্রদে মিশেছে। এই নালাগুলিতে নৌকাবিহারের ব্যবস্থাও আছে। পাখি দেখার জন্য। একসঙ্গে তিন লাখ পাখি থাকতে পারে এখানে। নভেম্বর থেকে মার্চ-এর গোড়া অবধি দেড় লাখ পাখি এখানে থাকে। বেশির ভাগ পরিযায়ী হলেও স্থায়ী বাসিন্দারাও আছেন। যে সমস্ত পাখিদের স্বর্গরাজ্য এই মোঙ্গলাজোড়ি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পার্পল সোয়াম্প হেন, ইয়েলো বিটার্ন, নর্দার্ন পিনটেইলস্‌, গ্লসি ইবিস, গার্গান্সি, নর্দার্ন শোভিলিয়ার প্রভৃতি।

জলাভূমির বুক চিরে লাল মাটির পথ। ঈষত্‌ উঁচু। চাকার ঘর্ষণে ধুলো উড়িয়ে পড়ন্ত বিকেলে পাখিদের স্বর্গরাজ্যে পৌঁছলো কঙ্কনদার গাড়ি। চারিদিকে কলকাকলিতে দিশেহারা অবস্থা। কাকে ছেড়ে কাকে দেখি। অন্তত চার পাঁচ ভিন্ন প্রজাতির পাখি চোখে পড়ল। তবে দলে ভারী পার্পল সোয়াম্প হেন-রাই। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই দল বেঁধে তারা। সকালে গডউইট ইকো-হাটে পৌঁছনোর সময় সবুজ মাঠেও মিলেছিল এদের উপস্থিতি। এখানকার প্রকৃতি বর্ণনা করার থেকে আবার বুদ্ধেদেব বসুর স্মরণাপন্ন হওয়াই ভাল। তবে উনি সকালবেলার বর্ণনা দিয়েছিলেন। এক্ষত্রে পড়ন্ত বিকেল। “…কী ভালো আমার লাগল আজ এই সকালবেলায় (বিকেলবেলায়)/ কেমন করে বলি?/ কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর,/ যেন গুণীর কণ্ঠের অবাধ উন্মুক্ত তান/ দিগন্ত থেকে দিগন্তে;…”

ভাবতে আশ্চর্য লাগে ১৯৯৭ অবধি এই অঞ্চল ছিল পাখিদের উন্মুক্ত এবং নির্বিচার বদ্ধভূমি। চোরা শিকারের ঠেলায় পাখিদের আসা কমে গিয়েছিল। তারপর স্থানীয় নন্দকিশোর ভুজওয়াল ম্যাজিক দেখালেন। মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির ম্যাজিক। আজ পাখি মারা দূর অস্ত্‌ পর্যটকরা কেউ পাখিদের বিরক্ত করলেও স্থানীয়রা প্রতিবাদ করেন। তাই মঙ্গল জুড়েছে বুঝেই পাখিদের আনাগোনা আবার বেড়েছে মোঙ্গলাজোড়িতে।

 

পরদিন সকাল সকাল বেরোবার কথা থাকলেও সেই সাড়ে আটটা বেজেই গেল। এরপর খোলা মাঠে পাহাড়ের ব্যাকড্রপে চলল সেল্ফি তোলার পালা। আসলে ৯টা বাজানোর চেষ্টা যাতে গাড়ির জুটুক না জুটুক আরোহিদের জ্বলানিটা এই টাঙ্গি থেকেই তোলা যায়।  কিন্তু বিধি বাম (কেন যে বিধি বরাবর এত বামপন্থী সে উত্তর মেলে না)। দোকান খোলেনি এখনও।

  • দশটার আগে তোদের প্রয়োজনীয় দোকান খোলে না এখানে।

সামনে যানচালক সংলগ্ন আসন থেকে কঙ্কনদার জলদগম্ভীর নিদান। অগত্যা। চরৈবেতি। অনকেটা পথ পারি দিতে হবে। পথ বেশ মনোরম। অবশ্যই গাড়ির এসি চালানোর পর। চওড়া মাখনের মতন মসৃণ জাতীয় সড়ক। দুপাশে সরে সরে যাচ্ছে ছোট ছোট টিলা পাহাড়। মাঝে মাঝেই সবুজ আন্দোলিত করে মন।

ভুবনেশ্বর পার করে রাস্তার বাম ধারে সার দিয়ে মিষ্টির দোকান। বাঙালি মিষ্টি দেখবে অথচ দাঁড়াবে না এহেন লজ্জায় যাতে পড়তে না হয়, গাড়ি দাঁড়াল। নলেনগুড়ের রসগোল্লা। সাইজ, স্বাদ এবং দামের আনুপাতিক অঙ্কটায় ডাহা ফেল। মন বা পেট কোনোটাই ভরল না। তবে কটক পার করেই যে এমন চমকপদ রসনাতৃপ্তি অপেক্ষা করছিল, ঘুণাক্ষরেও ভাঙেনি কঙ্কনদা। রাস্তার বাম ধারের গার্ডরেলের বাইরে সার দিয়ে মানুষ। সঙ্গে একটা করে সাইকেল। যাতে চাপানো পেল্লায় এক একটা ডেকচি।

  • অনেক রকম দইবড়াই তো খেয়েছিস। এটা একবার ট্রাই করে দেখ।

কঙ্কনদার গলায় একটা, কেমন দিলুম মার্কা আত্মতৃপ্তি শোনা গেল। দই আর বড়া তো আছেই সঙ্গে আলু আর সিদ্ধ করা মটরের গুঁড়ো লঙ্কা ভাসানো ঝোল, পেঁয়াজ কুঁচি, লঙ্কা কুঁচি আর নানাবিধ মশলা আর লবণ সহযোগে শালপাতায় পরিবেশিত হল। উফফ্‌ লিখতে বসে আবার মুখটা জলে ভরে গেল। স্বর্গীয় স্বাদ। ভাষার প্যাঁচপয়জারে না গিয়ে বলা ভাল ‘Better experience then explain’।

অবশেষে দশটা বাজল। রাস্তার ধারে পিপাসার্তদের ফ্যুয়েল স্টেশনও চোখে পড়ল। রিন্টুদা বার বার বলেছিল ভাই শুধু নিজেদের কথা মনে না রেখে মনে করে একট রাম-এর পাউচ প্যাক অবশ্যই যেন নেওয়া হয়। জানা গেল তা অন্য কারো তৃষ্ণা নিবারণার্থে নয়। সন্ধ্যার সম্ভাব্য বার-বি-কিউ এর জন্য চিকেন ম্যারিনেট করতে কাজে লাগবে। এরপর চলন্ত গাড়িতে রিন্টুদার নিপুন হাতের খেলা। গাড়িতে একফোঁটাও ফেলা যাবে না। এবং রিন্টুদা সফল। বাকি পথের জন্য, ‘উল্লাস!’

বালেশ্বর রেল স্টেশন থেকে সাড়ে সাতাশ কিমি দূরে গন্তব্য। পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। তারই কিলোমিটার দেড়েক আগে বাম দিকে স্বর্ণ কটেজ। নিপাট কাগুজে ছবি যেন। পাশেই কংক্রিটের বড় বাড়িও আছে। তবে এই পথিকদের ব্যবস্থা সংলগ্ন কুটিরের মেজাজে নির্মিত কটেজে। একেবারে ওডিশার গ্রামীন কুটিরের আদলেই তৈরি। ব্যবস্থাও দিব্য।

আহারের পর সকলেরই দিবানিদ্রায় বেজায় উত্সাহ চোখে পড়ল। কিন্তু রোদ পড়লে মন্দির দেখতে যাওয়ার কী হবে? কেউ আগ্রহী নয়। কারণ সকলেই একবার না একবার ঘোরা। কঙ্কনদার সমস্যা হাঁটুজনিত। তাই ঠিক হল যানচালক কৈলাসদার সহায়তায় একা পঞ্চম পথিকই যাবেন মন্দির দর্শনে। যদিও ভক্ত বলে কোনো অভিযোগ এযাবত্‌ তাঁর সম্পর্কে কাউকে করতে শোনা যায়নি। তবে ভাল পর্যটক হতে গেলে নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে বোঝাপড়া করতেই হয়।

পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দির নিয়ে এত লেখা হয়েছে যে লেখার ভার বাড়ানোর মানে হয় না। তবে এর স্থাপনা সংক্রান্ত ইতিহাসটিতে আর একবার চোখ বোলানো যেতেই পারে।

রামায়ণের রেফারেন্স বলছে, নীলগিরি পর্বত মালার অদূরের এই টিলাগুলোর একটার মাথায় পাঁচটি স্বয়ম্ভূ লিঙ্গ প্রথম দেখেন সীতা। তখন তাঁরা বনবাসে। তিনিই নাকি পুজো করে পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের প্রতিষ্ঠা স্বীকৃতি দেন।

অপর একটি মত বলছে রাজা বাণাসুর এই পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের প্রতিষ্ঠাতা। সে যাই হোক এখানকার প্রকৃতি এক কথায় অসাধারণ।

গাড়ি যেখানে ছেড়ে দিতে হল সেখান থেকেই শুরু পুজোর সামগ্রীর দোকান এবং পুজো শেষে ভক্তদের পেট পুজো করানোর ঢালাও ব্যবস্থা। আজ্ঞে না বিনামূল্যে অবশ্যই নয়।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু টিলা। তার ফাঁকফোকোরে তালগাছের মাথায় পাটে বসার আগে সুয্যিমামা একটু জিড়েন দিচ্ছেন। মন্দির যে টিলাটির মাথায় সেটিকে বিচ্ছিন্ন একটি টিলা না বলে অন্তত গোটা তিনেক টিলার কোলাকুলি বলাই যায়। অনেকটা উঠতে হবে সিঁড়ি ভেঙে। কেউ বলেন সিঁড়ির সংখ্যা ২৬৭ আবার উপরে উঠে শেষ সিঁড়িতে লেখা দেখা গেল ৩০১। মিলিয়ে নেওয়ার অবকাশ ছিল না। ওঠার সময় ফুসফুসের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে আর নামার সময় প্রকৃতির রূপসূধা পান করতে গিয়ে।

পাঁচটি লিঙ্গে সমানে স্নান করানোর দায়িত্ব প্রকৃতির। নিরবচ্ছিন্ন জলের স্বাভাবিক সাপ্লাই লাইনে। যা পরে সরু ধারায় এই সময়ের নেহাতই শীর্ণকায়া এক ঝর্ণা। ভোরে আসতে পারলে সূর্যস্নাতা সমতলকে উপর থেকে দেখার এক অনন্য অনুভব মিলতে পারে।

প্রায় ঘন্টা খানেক প্রকৃতির অনুষঙ্গে কাটিয়ে ফেরার পালা। ফিরে এক মস্ত চমক অপেক্ষা করে ছিল। বাইরে বের হলে পিছনে লাগালাগি হবেই। এদলও তার ব্যাতিক্রম নয়। সেক্ষত্রে ভিটুদার পিছনে খানিক বেশিই লাগা হয়ে যাচ্ছিল। ফলত পঞ্চম পথিকের সঙ্গে টুকটাক বাসনের ঠোঁকাঠুকিও চলছিল। যা বাকি তিনজন অনাবিল আনন্দে উপভোগ করতেও ছাড়েননি। চমকটা সেই ভিটুর কাছ থেকেই। তার ব্যাগে আবিষ্কৃত হয়েছে একটি স্কচের বোতল। রিন্টুদা এবং রাজুদা স্বভাবতই উল্লসিত। ভিটুদার নিন্দুকেরা আড়ালে কিপ্টে বলে বদনাম ছড়ানোর চেষ্টা করে কিনা। আসলে মহান লোকেদের তাই হয়। তা এহেন ভিটুদা তার সাধের স্কচকে আগলে রেখেছে বুক দিয়ে। কারণটা জানার পর সকলেই নির্বাক। পঞ্চম পথিকের কি চোখ ছলছল?

  • রাজা এবার আমাদের দলে প্রথম এসেছে তাই এটা শুধুই ওর। বাকিরা নিজেদের ব্র্যান্ডে থাকো। ও ছাড়া কেউ খাবে না। এটা ওর আমাদের দলের বন্দরে প্রবেশের স্বীকৃতি।

সোজা-সাপ্টা ঘোষণা। ভিটুদার। সবাই একবাক্যে মেনেও নিয়েছে তা।

অনুষঙ্গ হিসেবে বার-বি-কিউ ছিলই। রাম-এর সঙ্গতে তার স্বাদ যে এত খোলতাই হবে ধারণা ছিল না। অদ্যই শেষে রজনী। পরদিন আবার কংক্রিটের জঙ্গলে ফেরার পালা। তাই উদ্দামতা আর ঘড়ির কাঁটা চড়তে লাগল হাতে হাত ধরে।

 

বেড টি আর গরম জলের ব্যবস্থা করে দ্রুত তৈরি হওয়া। ঘরে ফেরার আগে জগন্নাথ দেবের দর্শন সারতে হবে। কঙ্কনদা আবার ভীষণ ভক্ত। পঞ্চমজনকে বাদ দিলে কম বেশি সবাই তাই।

ওডিশার চতুর্থ জনপ্রিয়তম জগন্নাথ মন্দির নীলগিরি রাজাদের প্রতিষ্ঠিত জগন্নাথ মন্দির। হরিচন্দন রাজবংশের রাজারাই স্বর্ণচুড়া পাহাড়ের কোলে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। জনপ্রিয়তার নিরিখে প্রথম পুরী, দ্বিতীয় কোরাপুটের শবর-শ্রীক্ষেত্র মন্দির এবং তৃতীয় বারিপাদার মন্দির।

জগন্নাথ দর্শন করেই রওনা দেওয়া হল কলকাতার উদ্দেশে। কঙ্কনদার নেতৃত্বে বছরে আট-দশবার রিন্টুদা, ভিটুদারা পাড়ি দেয় নানান অজানার খোঁজে। সেই দলে এবারেই প্রথম শিকে ছিঁড়েছে। হঠাত্ দুদিনের এই বেরিয়ে পড়া নিঃসন্দেহে জীবনযুদ্ধে যোঝার রসদ এনে দেবে খানিকটা।

শব্দ-জব্দ

আবার অন্তর্ধান

আজ উইকলি অফ ডে। আজ ফুলটু ল্যাদ খাওয়ার দিন। তবে চিফ রিপোর্টার হিসেবে প্রমোশন পাওয়ার পর থেকে ল্যাদ খুব একটা হয় না। সারাক্ষণ-ই ফোন বাজতে থাকে। মা ভীষণ বিরক্ত হন। তাঁর মতে এর থেকে আমি অফিসে থাকলেই শান্তি। আগে হা-পিত্যেশ করতেন আমার বিয়ে টিকবে না ভেবে। তারপর স্যান্ডির আর আমার ব্যাপারটা জেনে অবধি সে চিন্তা কমেছে। তাঁর সখেদ উক্তি “যেমন দ্যাবা তেমনি দেবি, একেবারে রাজযোটক।”

সত্যিই মায়ের কথাটাও ফ্যালনা নয়। সাংবাদিকতা, বিশেষত টেলিভিশন মিডিয়ায় নিজের জন্য কোনো সময় নেই। দায়িত্বে থাকলে তো আরও নয়। সিনেমা হলেও অ্যাসাইনমেন্ট ডেস্ক বা রিপোর্টারদের ফোন ধরতে হয়। আসপাশের দর্শক বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। উঠে বেরিয়ে যেতে হয়। তবে সাম্প্রতিক-কালে মা-এর কপালের ভাঁজ স্যান্ডি অর্থাত্‌ তাঁর হবু বৌমা-কে নিয়ে। চিফ অ্যাঙ্কর আর সিনিয়র রিপোর্টার ব্যাপারটা মেনে নিলেও ওর গোয়েন্দাগিরিটা হজম করতে পারছেন না। না, না কোনো ট্যাবু নেই। বৌমা-র নিরাপত্তাজনিত চিন্তা আর কি! স্যান্ডির বাবা-মা তো সাক্ষর বুঝবে বলে আমার কোর্টে-ই বল ঠেলেছেন। তবে আমি জানি আমার সাপোর্টটাই স্যান্ডির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। হঠাত্‌ কলিং বেল বেজে ওঠে। এখন আবার কে!

বোঝো! শয়তান কা নাম লিয়া শয়তান হাজির। স্যান্ডির উত্তেজিত গলা শুনতে পাচ্ছি। দোহাই পাঠককূল এই শয়তান সংক্রান্ত মন্তব্যটা যেন স্যান্ডির কানে তুলবেন না। জঙ্গী মেয়ে, তায় ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট।

  • কিরে ল্যাদ খাচ্ছিস তো?

সোজা আমার ঘরে। অনুমতি-টতির বালাই নেই। একবার বলতে গিয়ে ঝাড় আর জ্ঞানের বন্যায় সুনামিগ্রস্থ হয়েছিলাম। অর্থাত্‌ নিজের ঘরের অধিকারটা আগেভাগেই নিয়ে নিয়েছে। অগত্যা!

  • আমার তো অফ ডে। তোর তো আজ মর্নিং শিফ্ট! তুই অফিস ছেড়ে এখানে কেন?

  • দাঁড়া বাবা বসতে দে। একেবারে ক্যাডাভ্যারাস সিচ্যুয়েশন।

সোফায় নিজের দেহটাকে ছেড়ে দেয় স্যান্ডি। ব্লু জিনস আর মেরুন টপ। হেব্বি সেক্সি লাগছে। বললেই ক্যালাবে।

  • সাক্ষরদা আসছি?

আমাকে অবাক করে দিয়ে কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘরে ঢোকে আমাদের চ্যানেল ফাইভের সিনিয়র ক্যামেরাপার্সন সোমেন।

  • যাঃ বাবা, ব্যাপারটা কি বলবি তো তোরা?

  • কাল তুই অফিস থেকে বের হওয়ার আগে যে ব্রেকিংটা কন্টিনিউ করতে বলে এলি মনে আছে? তুই নাকি বলেছিলিস এটার ইন্টারেস্টিং ফিচার আছে।

  • হ্যাঁ, কেন মনে থাকবে না! কলকাতার বিখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ সন্দীপ দে-র রহস্যজনক অন্তর্ধান। তাও আবার পুরুলিয়ার বরোন্তিতে। সপরিবারে বেড়াতে গিয়ে। জব্বর খবর। একটু আগে চ্যানেলে দেখলাম। চলছে তো! আজ ভোরে টিম পাঠাতেও বলেছিলাম।

আমি বেশ অবাকই হই। মর্নিং শিফ্টে বিক্রমের থাকার কথা। ওকে আর ক্যামেরায় রাজর্ষিকে পাঠাতে বলেছিলাম। স্যান্ডি রহস্যের ব্যাখ্যা দেয়।

  • তাই ঠিক ছিল। চিফ এডিটর বিশ্বজিতদা অ্যাসাইনমেন্টে ফোন করে ওদের যেতে বারণ করেন। তারপর আমায় ফোন। বললেন আমি যেন সোমেনকে নিয়ে যাই আর যাওয়ার পথে তোকে তুলে নিই। তোকে ফোন করেননি?

স্যান্ডি শেষ করতে না করতেই আমার ফোন বেজে ওঠে। বিশ্বজিতদা।

  • কি ব্যাপার কি, সাক্ষর? বাড়িতে কি ফোন মাটি চাপা দিয়ে রাখো? খালি বলে নট রিচেবল!

  • আসলে বিশ্বজিতদা, পুরনো বাড়ি তো, ২০ ইঞ্চির দেওয়াল, তাই বোধহয়…

  • যাকগে যাক। স্যান্ডি পৌঁছেছে?

  • জাস্ট এলো। কিন্তু ব্যাপারটা কি এখনও জানিনা!

  • শোনো তোমার উইকলি অফ ক্যান্সেল। পরে দিয়ে দেব। তুমি এখনি রেডি হয়ে স্যান্ডিদের সঙ্গে বরোন্তি রওনা দাও।

  • স্যান্ডি সিনিয়র রিপোর্টার। ও যাচ্ছে। তারপরেও আমি..!

  • জানি, জানি। ওটা আমি বুঝবো। আমি আমার বেস্ট দুজনকে পাঠাচ্ছি। তোমার রিডিং-টা ঠিক, এটা বড় খবর হবে। স্যান্ডি যাবে গোয়েন্দা কাম অ্যাঙ্কর হিসেবে। তুমি যাবে চ্যানেলের বেস্ট রিপোর্টার, তাই। বাকিরা জেলার ছেলেদের দিয়েই কভার করাচ্ছে। কিন্তু আমরা আর একটা রাঘবেন্দ্র মিত্র অন্তর্ধান রহস্য উদ্ঘাটন করতে চাই (গল্প- ফিসফাস)। বস, টি আর পি-টা ভাবতে হবে তো। তাছাড়া তুমি না গেলে পরে গল্পটা কে লিখবে!

একটা বিচ্ছিরি রকম ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসলেন বিশ্বজিতদা। অগত্যা!

চলো বরোন্তি

দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরেছে আমাদের গাড়ি। আসানসোল হয়ে সেখান থেকে বাঁদিক নেব। তারপর গড় পঞ্চকোট বা পাঞ্চেত পাহাড়কে ডাইনে রেখে আমাদের ঢুকতে হবে বাঁদিকে বরোন্তি যাওয়ার জন্য।

  • কাল যখন খবরটা হয় আই ওয়াজ আউট অফ অফিস। আজও খবর দেখা হয়নি। আমাকে একটু ব্রিফ করবি সাক্ষর, প্লিজ?

গাড়ির মাঝের সিট-এর ডানদিকে জানলার ধারে বসে স্যান্ডি। বাঁদিকে সোমেন। আমি সামনে। আলগোছে ঘুরে বসি ওর দিকে।

  • আমাদের পুরুলিয়ার স্ট্রিঙ্গার প্রথম খবরটা দেয় সন্ধ্যে নাগাদ। তার আগেরদিন মানে পরশু রাত থেকে ডাঃ দে মিসিং। যদিও সকালের আগে ওঁর সঙ্গের লোকেরা রি-অ্যাক্ট করেনি। সকালে বারে বারে ফোনে না পেয়ে এবং কলকাতা-তেও ফেরেননি জেনে স্থানীয় থানায় মিসিং ডায়রি করান। পরশু বিকেলে বরোন্তি ড্যাম ধরে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন ডাঃ দে। একাই। তারপর আর কেউ তাঁকে দেখেননি।

  • কে কে বেড়াতে গিয়েছিল জানিস?

  • সস্ত্রীক ডাঃ দে এবং তাঁর আরও তিন বিজনেস পার্টনার। সকলেই স্ত্রীদের নিয়ে। এরমধ্যে আরও চার জন চিকিত্‌সক আছেন। কলকাতার বিখ্যাত চাইল্ড এন্ড মেটারনিটি কেয়ার নার্সিংহোমের সঙ্গে যুক্ত সকলেই। তারমধ্যে ডাঃ সন্দীপ দে আবার শাসক দলের ঘনিষ্ঠ। তাই হইচই-টা ভালই হবে। আমার ধারনা সেই জন্যই বিশ্বজিতদা চান্স নিতে চায়নি।

  • রাইট ইউ আর।

গম্ভীর হয়ে যায় স্যান্ডি। বুঝতে পারি ওর মাথায় এখন নানান প্রশ্ন ঘুরছে। বরোন্তি না পৌঁছলে যার একটারও উত্তর পাওয়া যাবে না। সোমেন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। আসলে এই মুহুর্তে ওর করারও কিছু নেই।

হঠাত্‌ সেল ফোনটা বেজে ওঠে। সুবীর। আমাদের পুরুলিয়ার স্ট্রিঙ্গার।

  • হ্যাঁ, সুবীর বল।

  • দাদা, তোমরা রওনা দিয়েছো?

  • হ্যাঁ, শক্তিগড় ক্রশ করছি। ওদিকে কোনো ডেভেলপমেন্ট?

  • সেটা জানাতেই ফোন করলাম। ডাঃ সন্দীপ দে-র ডেডবডি পাওয়া গেছে।

  • হোয়াট? অ্যাসাইনমেন্টে খবর দিয়েছিস?

  • হ্যাঁ, ওরাই জানালো তোমরা আসছো। আর সমস্ত আপডেট দিতে বলল।

  • কোথায় পাওয়া গিয়েছে ডেডবডি?

  • পাঞ্চেত পাহাড়ের নিচে জংলা জলাজমির পাশে। স্থানীয় এক গ্রামবাসী কাঠকুটো আনতে জঙ্গলে ঢুকেছিল, সেই দেখেছে।

  • কি ভাবে মারা গেল?

  • পুলিশ বলছে পাহাড় থেকে পড়ে। তবে মাথায় অন্য রকম চোট আছে বলেও সন্দেহ করছে। খোদ এসপি সাহেব তদন্তে রয়েছেন।

  • যেখান থেকে পড়েছে বলে ডাউট করছে, ইজ দ্যাট প্লেস ইজি অ্যাক্সেসেবল? জিগ্যেশ করতো সুবীরকে।

প্রথম থেকেই স্পিকার অন করা ছিল। যাতে স্যান্ডি পুরো কথোপকথনটা শুনতে পায়। আমাকে জিগ্যেশ করতে হয়না। সুবীর শুনতে পেয়েছে।

  • হ্যাঁ, স্যান্ডিদি। ওখানে গাড়ি নিয়ে ওঠা যায়। তবে কাঁচা রাস্তা। বড় চাকার গাড়ি ছাড়া হবে না।

  • সুবীর, পাহাড়ের ওই জায়গার হাইট কতটা হতে পারে?

  • বারো-চোদ্দ’শ ফিট হবে।

  • ওকে, তুই পুলিশের সঙ্গে লেগে থাক। পারলে ডাঃ দে-র সঙ্গীদের রি-অ্যাকশন পাঠা অফিসে।

  • পাঠিয়েছি সাক্ষরদা। ওরা কিছুই বুঝতে পারছেন না।

 

না, ব্যাপারটা আর রাঘবেন্দ্র মিত্র অন্তর্ধান রহস্য থাকল না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে উনি কেন গেছিলেন ওখানে? আত্মহত্যা! স্যান্ডি বোধহয় আমার ভাবনার গতিপ্রকৃতি আঁচ করেছে।

  • হোমিসাইড হওয়ার প্রব্যাবিলিটি মোর দ্যান নাইনটি নাইন পার্সেন্ট।

  • তুই কি করে এখান থেকে এত শ্যিওর হচ্ছিস?

  • সি, ডাঃ দে অ্যারাউন্ড সিক্সটি ইয়ারস। রাইট? খামোখা বরোন্তি থেকে গড় পঞ্চকোট অতটা রাস্তা হাঁটবেন কেন? তাছাড়া শুনেছি বরোন্তির আসপাশে আরও পাহাড় আছে। দোজ আর মাচ নিয়ারার। এখন উনি যদি গাড়ি নিয়েই যাবেন তাহলে গাড়ির কথা কেউ বলছে না কেন? কারন ওখানে গাড়ি নেই। অর্থাত্‌ কেউ একজন ছিল। যে গাড়ি নিয়ে ফিরেছে। তারমানে সেই মার্ডারার।

  • কে সে?

  • ইডিয়টের মতন কথা বলিস না সোমেন। এখান থেকে কেমন করে বলব!

প্রশ্ন করে খামোখা ঝাড় খেয়ে চুপ করে যায় সোমেন। আমি জানি স্যান্ডির অনুমান নির্ভুল। খুবই যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যা।

 

পাঞ্চেত মোড় পার হলাম তখন প্রায় তিনটে বেজে গিয়েছে। স্যান্ডি আগেই বলে দিয়েছিল ও পাঞ্চেত পাহাড়ে আগে উঠতে চায়। যেখান থেকে ডাঃ দে পড়েছেন বা তাঁকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। একটা পিটুসি-ও(পিস টু ক্যামেরা) করবে। কারন পৌঁছে একটা ফিড তো পাঠাতে হবে চ্যানেলের জন্য। বাবলু, আমাদের যানচালক নিজেই দায়িত্ব নিয়েছে লোকজনকে জিগ্যেশ করে রাস্তা খুঁজে বের করার।

  • সাক্ষর, গড় পঞ্চকোট সম্পর্কে কিছু জানিস? আসলে রিসার্চ করার সময় পেলাম না। জায়গাটা এস্টাব্লিশ করতে গেলে একটু ইতিহাস ভূগোল বলতে হবেতো। নাহলে মার্ডার কেস ঠিক জমবে না।

যতটা জানা আছে গাড়িতেই ব্রিফ দিলাম স্যান্ডিকে।

  • পূর্বভারতের প্রাচীনতম রাজত্ব গড় পঞ্চকোট। প্রায় নব্বই খ্রীস্টাব্দে দামোদর শেখ পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন জনজাতি বা খুঁট-দের নিয়ে এই রাজত্ব স্থাপন করেন। পাঁচ খুঁট থেকেই পঞ্চখুঁট বা পঞ্চকোট। পুরাণে শেখরভূমি বা শেখরভূম নামে এ অঞ্চলের উল্লেখ আছে। তারপরই দামোদর শেখের রাজচাকলা রাজবংশের দুর্গ তৈরি হয় এই পাহাড়ে। দুর্গ থেকে গড়। তাই গড় পঞ্চকোট। পরে এই রাজবংশের নাম হয় সিংদেও রাজবংশ। সেও মোটামুটি মধ্যযুগে এসে। একটা ইন্টারেস্টিং তথ্য দিই। তোর কাজে লাগবে। এই পাহাড়ের বিস্তৃতি প্রায় ১৮ কিলোমিটার আর সর্বোচ্চ পয়েন্ট ২১০০ ফিট। শোনা যায় রাজ আমলে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীদের পাহাড়ের এরকমই কোনো এক উঁচু জায়গা থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হত হত্যা করার জন্য। যে কারনে এ পাহাড়কে ঘাতক পাহাড় বা এক্সিকিউশন হিল-ও বলা হয়।

  • ফাটিয়ে দিয়েছিস সাক্ষর। এক্সিকিউশন হিল থেকে ডাঃ সন্দীপ দে’র এক্সিকিউশন! জাস্ট জমে যাবে।

কুশীলবেরা

প্রয়োজনীয় শ্যুটিং সেরে ফিড পাঠিয়ে থানায় গেলাম। বলা হয়নি আমাদের পিছন পিছন ডিএসএনজি ভ্যানও (ডাইরেক্ট স্যাটেলাইট নিউজ গ্যাদারিং যাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুল করে ওবি ভ্যান বলা হয়) পাঠিয়েছেন বিশ্বজিতদা। যাতে সময় সময় লাইভ করা যায়। স্থানীয় থানা হাব-ভাবেই বুঝিয়ে দিল খুব একটা পাত্তা পাওয়া যাবে না। তাই সরাসরি এসপি সাহেবকেই ফোন করলাম। আগেই আলাপ ছিল। তাই পরিচয় দেওয়ার ঝক্কি ছিলনা। তবে উনি যে স্যান্ডির সাম্প্রতিক গোয়েন্দাগিরি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল জেনে চমকে গেলাম। সবরকম সাহায্যের আশ্বাস মিলল। নেহাত স্যান্ডির টপ-এর কলার নেই, থাকলে ছেড়ে কথা বলত না। কারন ও এটাকে আজকাল বেশ রেলিশ করে।

বরোন্তি ঢুকলাম অন্ধকারে। যে আকাশগঙ্গা রিসোর্টে ডাঃ দে-র টিম আছে সেখানেই দুটো রুম পাওয়া গেল। সকলের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় সেরে রুমে এলাম। আজ রাতের মতন কিছু করার নেই। খালি পরিচয় হয়নি মিসেস দে-র সঙ্গে। ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে।

  • আপাতত যাঁদের সঙ্গে আলাপ হল তাঁদের কাকে কি বুঝলি?

ল্যাপটপে নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল স্যান্ডি।

  • ডাঃ তাপস দত্ত। ইনি স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। বয়স ৬০-৬৫। নার্সিংহোমে শুরু থেকেই আছেন। উচ্চতা পাঁচ ফুট তিন বা চার। স্বাস্থ্য ভাল। মাঝারি রঙ। তবে সবথেকে গ্ল্যামারস তাঁর টাক খানা। চুরুটপানের বদভ্যাস আছে।

  • আর?

  • আর কি!

  • মুদ্রাদোষটা বললি না?

  • রাইট, কথায় কথায় আই মিন বলার রোগ আছে।

  • নেক্সট।

  • এনার ঘরণী। ইনিও চিকিত্‌সক। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। নাম সুমনা দত্ত। বয়স ৪০ এর বেশি নয়। খুব সম্ভবত দ্বিতীয় পক্ষ। হাইট বরের সমান। ফিগারটি খাসা। মনে হয় নিয়মিত জিম করেন, তোর মতন। দেখতেও দিব্য। তবে মুখে একটা আপাত কাঠিন্য আছে। মিতভাষী।

  • বাঃ। তারপর মাই ডিয়ার হবু হাবি?

স্যান্ডি-র মেজাজ বেশ খুশ। তাই একটু তোয়াজের সুর। শুনতে অবশ্য ভালই লাগে।

  • মিস্টার মহেশ রাঘবন। তিনপুরুষ এ বঙ্গদেশেই বাস। তাই পুরোদস্তুর বাঙালি। ইনি নার্সিংহোমের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ইনচার্জ। গায়ের রঙ বেশ কালো। কালো জামা পড়ে রাতে দাঁড়ালে খুঁজে পাওয়া যাবেনা।

  • তোর ফুটনোট গুলো বাদ দিয়ে বল।

  • হাইট প্রায় ৬ ফিট। ফিগার স্লিম। এক মাথা কাঁচা পাকা চুল।

  • সল্ট অ্যন্ড পিপার।

  • হ্যাঁ, মুখে সবসময় হাসি ঝুলে আছে। যেন বিগলিত ভাব। বয়স ৪০ থেকে ৬০ এর মধ্যে যা খুশি হতে পারে।

  • খুব সম্ভব ৬০ এর উপরেই। ডাঃ দত্ত-র সঙ্গে নাম ধরে তুই-তোকারির সম্পর্ক। তারপর।

  • ডাঃ শ্রীলা রাঘবন। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। মাঝারি উচ্চতা। খুব কমন ফেস। একটু মা মা ব্যাপার আছে। মিসেস দে-কে ইনিই সামলাচ্ছেন। বয়স ৫৫ থেকে ৬০ এর মধ্যেই।

  • হুম

  • ডাঃ সমর মল্লিক। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। ৬০-৬২। মাঝারি উচ্চতা।

  • উঁহু মাঝারি বললে হবে না।

  • পাঁচ পাঁচ বা পাঁচ ছয়।

  • রাইট।

  • দৃশ্যত এনাকেই সব থেকে শকড মনে হল। একটু বাঙালিয়ানা আছে।

  • ধুতি পাঞ্জাবি পরে ছিলেন বলে বলছিস?

  • সেটা একটা কারন, তবে বাকি দুই ভদ্রলোক শেক হ্যান্ড করলেন। মিসেস-রাও একজন ছাড়া সকলেই হায় হায় রব তুললেন। এনার মিসেসও। ইনি কিন্তু যুক্তকরে নমস্কার করলেন আলাপের সময়।

  • গুড অবজার্ভেশন। এইজন্যই তুই ভাল রিপোর্টার। বলে যা।

  • স্বপ্না মল্লিক। বললেন তো হাউজওয়াইফ।

  • উঁহু, হাউজওয়াইফ বলেননি, বলেছেন হোমমেকার।

  • ঐ একই হল।

  • তা বললে চলবে কেন! বেশ বলে যা।

  • আধুনিকতার চলমান বিজ্ঞাপন। পোষাক-আসাক আর প্রসাধনে দুর্ঘটনার কোনো ছাপ নেই। বয়স ৫০ এর ওপরে কিন্তু ৪০-এর নিচে নামানোর আপ্রাণ চেষ্টা। সম্ভবত কিটি পার্টি আর সোস্যাল ফাংশনেই দিন কাটে।

  • বেশ, তাহলে একটা ছবি পাওয়া গেল, কি বল? এবার কাল সকালে একটু বাজিয়ে দেখতে হবে।

  • কিন্তু ওরা তোকে মেনে নেবে কেন? যতক্ষণ অ্যাঙ্কর আছিস ঠিক আছে, গোয়েন্দা হতে চাইলেই প্রতিরোধ আসবে। আমার তো তাই ধারনা।

  • আমারও তাই মনে হয়। কায়দা করতে হবে। প্রয়োজনে এসপি সাহেবের সাহায্য নিতে হবে। আপাতত দুটো কাজ, কথা বলে মোটিভ সম্পর্কে একটা ধারনা তৈরি করা আর পোস্টমর্টম রিপোর্ট-টা জানা। সেতো পরশুর আগে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

  • কিন্তু পাবলিকদের কি পরশু অবধি আটকানো যাবে?। যা প্রভাবশালী লোকজন, পুলিশকে হয়তো পাত্তাই দেবেনা। কালই না কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেয়। তাহলে তো আমাদের আসাটা পুরো মাটি।

  • ছাড়তো কাল সকাল হলে দেখা যাবে। খুব টায়ার্ড লাগছে আমি শুচ্ছি।

  • তুই শো, আমি দেখে আসি সোমেন আর বাবলু ঠিক আছে কিনা। গুড নাইট।

তদন্ত

বাড়ির বাইরে এলেই কেন কে জানে আমার ঘুম ভেঙে যায় ভোরবেলায়। বরোন্তিতেও ব্যাতিক্রম হল না। এখন পৌনে পাঁচটা। সোমেন বলেছিল আগে উঠলে ওকেও ডাকতে। ভোরে ভাল ছবি হয়। তাছাড়া এলাকাটাও দেখিনি এখনও। স্যান্ডিকে ডাকলাম। তারপর মিনিট পনেরোর মধ্যে তিনজনে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

আকাশগঙ্গা রিসর্টটা বরোন্তি দীঘির এক প্রান্তে। সামনে পথ সোজা চলে গেছে দীঘির ধার বরাবর। তারপর তিনদিক বেড় দিয়ে বেরিয়ে গেছে মুরাডিহ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দিকে। অসাধারন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কাল অন্ধকার থাকায় কিছুই টের পাইনি। দীঘির চারপাশ ঘিরে অনেকগুলি টিলা। পরে জেনেছিলাম মোট বারোটা টিলা পাহাড় আছে। যার মধ্যে রিসর্টের ঠিক পিছনে বরোন্তি পাহাড়, আর উল্টোদিকে দীঘির অপর পাড়ে ভালুক পিঠ। এ ছাড়াও উত্তরদিকে আছে বিহারীনাথ পাহাড়। আর এই দীঘি কোনো স্বাভাবিক দীঘি নয়। আগে ছিল ওপেনকাস্ট কোলমাইনস তারপর পরিত্যক্ত অবস্থায় চারপাশের পাহড় থেকে বর্ষার জল জমে জমে দীঘি। তবে জল কিন্তু কাকচক্ষু স্বচ্ছ। মোটকথা বরোন্তি এককথায় খাঁটি ট্যুরিজম ডেস্টিনেশন।

সোমেন মনের মতন সাবজেক্ট পেয়ে মন দিয়ে ছবি তুলছে। স্যান্ডি দীঘির পাড়ে একটা পাথরে বসে। বুঝলাম প্রকৃতি ওরও মন কেড়েছে। ‘ভিনি ভিনি ভোর’ গুনগুন করছে। মেয়েটা এত ভাল গায়, কিন্তু গানকে কিছুতেই সিরিয়াসলি নিল না। উল্টোদিকের ভালুক পিঠ পাহাড়ের পিছন থেকে তখন সুর্য উঁকি মারছে। একটা পিকচার পার্ফেক্ট ভোর।

সকাল আটটার মধ্যে পুরুলিয়ার এসপি মিস্টার মিনা হাজির। তাতে অবশ্য আমাদের সুবিধেই হয়েছে। স্থানীয় থানার যে মাতব্বররা কাল আমাদের পাত্তা দিতে চায়নি তারাই আজ গদগদ। স্যান্ডি এসপি সাহেব-কে বুঝিয়েছে ওর সমস্যার কথা। উনিও সকলকে জানিয়ে দিয়েছেন যে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না আসা অবধি কেউ কলকাতা ফিরতে পারবেন না। আর স্যান্ডি ওনাকে তদন্তে সাহায্য করছে তাই সকলে যেন ওকে কো-অপারেট করেন।

এর মধ্যে আমাকে দুটো লাইভ দিতে হয়েছে। যদিও নতুন কিছু বলার মতন এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু ২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেলে একই কথা বলে যেতেই হয়। ব্রেকফাস্টের পর স্যান্ডি সকলের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলবে জানিয়েই রেখেছিল।

প্রথমেই গেলাম মিসেস দে-র কাছে। ভদ্রমহিলা খানিকটা সামলে উঠেছেন বলেই মনে হল। পুরো নাম সোমা দে। ডাঃ শ্রীলা রাঘবনও ঘরে ছিলেন। স্যান্ডি ওনাকে অনুরোধ করল একটু অন্য রুমে যাওয়ার জন্য।

  • আমি বুঝতে পারছি ম্যাডাম, এই অবস্থায় আপনার পক্ষে কথা বলা মুশকিল তবুও…

  • না না, আপনি বলুন। কি জানতে চান?

  • আপনি নিশ্চয় জানেন ডাঃ দে-র মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। রাদার বেটার টু সে, পুলিশ এবং আমারও ধারনা ইট ইজ আ কেস অফ হোমিসাইড। কিন্তু কেন? এটা একমাত্র আপনিই খানিকটা আন্দাজ দিতে পারেন।

  • আমি জানি না কি বলব আপনাদের। ওনার মতন মানুষ হয় না। সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন উনি।

মিসেস দে একটু আনমনা হয়ে পড়লেন।

  • রিসেন্টলি কি কোনো কারনে ডিস্টার্বড ছিলেন?

স্যান্ডির প্রশ্নে খানিক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন মিসেস দে।

  • জানিনা এর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, তবে নার্সিংহোম নিয়ে কিছু ঝামেলা হচ্ছিল বলে আন্দাজ পেয়েছিলাম।

  • প্লিজ, একটু ডিটেইলসে বলুন।

  • নার্সিংহোমে এনারা চারজন পার্টনার ছিলেন।

  • মানে ডাঃ দে, ডাঃ দত্ত, ডাঃ মল্লিক এবং মিস্টার রাঘবন?

  • হ্যাঁ, কিন্তু ডাঃ দত্ত মানে তাপসবাবু নন। সুমনা। তবে তাপসবাবু আর আমি বোর্ড অফ ডিরেক্টরস-এ আছি।

  • হুম, তা প্রবলেমটা কোথায়?

  • ওনার কাছে শুনেছিলাম গত বেশ কিছুদিন যাবত নার্সিংহোমের ফান্ডে একটা বড়সর গোলমাল হচ্ছে। প্রচুর টাকার হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না। আসলে এই বরোন্তি বেড়াতে আসার কারনই ছিল সকলে মিলে একটা হেস্তনেস্ত করা। উনি বলেছিলেন এর শেষ দেখে ছাড়বেন। আসার পর ডাঃ তাপস দত্তর সঙ্গে একচোট কথা কাটাকাটিও হয়। যদিও কারনটা আমি জানিনা।

একটানা অনেকগুলো কথা বলে থামলেন মিসেসে দে।

  • থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। আপাতত এটুকুই। পরে প্রয়োজন হলে আবার বিরক্ত করবো।

আমরা বেরিয়ে আসছিলাম। দরজার কাছে এসে স্যান্ডি হঠাত্‌ থামল। তারপর মিসেস দে-কে আবার প্রশ্ন করল..

  • আচ্ছা ডাঃ দে কি ডায়রি লিখতেন? অর এনি আদার হ্যাবিটস? কোনো হবি?

  • না, অন্য কিছু নয়। তবে শব্দজব্দ করতে ভালবাসতেন। আর রিডল, ধাঁধা এগুলো নিয়ে ছেলেমানুষের মতন করতেন মাঝে মাঝে।

  • থ্যাঙ্ক ইউ।

-হঠাত্‌ এ প্রশ্ন?

বাইরে এসে জানতে চাই স্যান্ডির কাছে।

  • বোঝার চেষ্টা করছিলাম ডাঃ দে-র ডায়রি এটসেট্রায় যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়। কারন মিসেস দে-র কথায় একটা ক্ষীণ আলো পেলেও তা যথেষ্ট নয়।

  • মানে বলছিস নার্সিংহোমের টাকা নয়ছয়-ই আসল মোটিভ।

  • টু আর্লি টু সে। বাট একটা ইম্পর্ট্যান্ট প্রোবাবলিটি তো বটেই।

 

বাইরে আসতেই ডাঃ সমর মল্লিকের সঙ্গে দেখা। একগাল হেসে নমস্কার করলেন। প্রতিনমস্কার করে স্যান্ডি তার মনোবাসনা জানালো। অর্থাত্‌ কথা বলতে চায়। রিসর্টের সামনের দিকে খোলা জায়গায় ছাতা লাগানো। চমত্‌কার বসার ব্যবস্থা। ওখানেই বসলাম তিনজন। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। সোমেন আর বাবলু বেরিয়েছে কোথাও। আপাতত কোনো লাইভ নেই। নতুন ফিড-ও নেই পাঠানোর। তাই একটু রিল্যাক্স মুডে সবাই।

  • আমাদের পুলিশের কি হাল হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। না হলে একজন টেলিভিশন অ্যাঙ্করের সাহায্য চায় তদন্তে!

সমরবাবুর গলায় স্যান্ডির প্রতি শ্লেষ স্পষ্ট। তবে স্যান্ডি পাত্তা দিল না।

  • আপনি কি আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবেন?

  • বিলক্ষণ, বিলক্ষণ। তবে প্রশ্নের কিছু নেই রহস্য জলবত্‌ তরলম।

  • ইজ ইট সো?

  • হ্যাঁরে বাবা। আপনি তাপস দত্তকে ধরুন। সব রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে।

  • মানে? একটু ক্লিয়ার করবেন প্লিজ।

  • রহস্যের জট তাপস দত্তর মিসেস-এ।

  • বুঝলাম না।

  • না বোঝার কি আছে! সন্দীপ আর সুমনার তলায় তলায় সম্পর্ক ছিল। অনেকদিনের সম্পর্ক। তা কোন বর তার বউ-এর পরকীয়া মেনে নেবে বলুন! তারপর সোমবার এখানে পৌঁছনোর পরেই তো লেগে গেল দুজনের। মানে তাপস আর সন্দীপের।

  • আপনি শুনেছেন, কি নিয়ে লেগেছিল?

  • তা শুনিনি তবে তাপস কিন্তু সন্দীপকে শাসাচ্ছিল সেটা শুনেছি।

  • একথা পুলিশকেও বলেছেন নাকি!

  • আমার যেন আর কাজ নেই। মশাই তদন্ত করা পুলিশের কাজ আমি বলতে যাব কেন?

  • আমাকে বললেন যে বড়!

  • আপনি বাচ্চা মেয়ে। আপনি যদি অপরাধীকে ধরে ফ্যালেন তাহলে পুলিশের দৌড়টা পরিস্কার হয়ে যাবে। তাই আপনাকে সাহায্য করলাম।

  • থ্যাঙ্কস। মঙ্গলবার অর্থাত্‌ যেদিন বিকেলে সন্দীপবাবু মিসিং হন। আপনি কোথায় ছিলেন?

  • আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন? তাহলে সময় নষ্ট করছেন। বলেই তো দিলাম।

  • যা জানতে চাইছি বলতে আপনার আপত্তি আছে?

এবার স্যান্ডির গলাটা একটু কড়া হয়। ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত্‌ কনফিডেন্সের আভাষ।

  • না আপত্তি নেই। আমি দুপুরে খাওয়ার পরই বেরিয়ে যাই। একটু জয়চণ্ডি পাহাড়ের দিকে গিয়েছিলাম গাড়ি নিয়ে।

  • একা?

  • হ্যাঁ, সন্ধেবেলা ফিরি।

  • চারটে গাড়ি দেখছি। আপনারটা কোনটা?

  • ওই ক্রিম কালারের স্কর্পিওটা।

  • থ্যাঙ্কস ফর ইওর কো-অপরেশন।

  • আবার বলছি তাপস দত্তকে ধরুন।

একট ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে উঠে গেলেন ডাঃ মল্লিক।

  • কি বুঝলি, সাক্ষর?

  • বুঝলাম ডাঃ মল্লিক বেশ ঘোড়েল লোক।

  • হোয়াট ডু ইউ থিঙ্ক, ইজ হি টেলিং ট্রুথ?

  • বুঝতে পারছি না।

  • হুম, নিড টু থিঙ্ক। তবে বাকিদের সঙ্গে কথাগুলো বলা দরকার।

 

বিশদে না গিয়ে বাকিদের কাছে যা যা জানা গেল তা মোটামুটি এরকম- ডাঃ তাপস দত্ত। ঝগড়া সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করবেন না। নার্সিংহোমের ব্যাপারে একজন রিপোর্টারের সঙ্গে কোনো আলোচনা করতে চান না। মঙ্গলবার সারাদিন রিসর্টেই ছিলেন। নিজের রুমে টিভি দেখছিলেন। বাকিরা কে কি করছিল জানেন না। জানার ইচ্ছেও নেই।

ডাঃ সুমনা দত্ত। ডাঃ দে-কে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। ওনার আন্ডারে ইন্টার্নশিপ করেছেন। নার্সিংহোমে একটা আর্থিক গন্ডগোল চলছে। ডাঃ দে বলেছিলেন এখানে এসে ফাঁস করবেন। নার্সিংহোমের আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারটা সাধারনত ওনার হাজব্যান্ড এবং মিস্টার রাঘবন হ্যান্ডেল করেন। তবে ডাঃ মল্লিকও স্টক এবং পার্চেজের ব্যাপারটা দেখেন। মঙ্গলবার বিকেলে বেরিয়েছিলেন। একা। গিয়েছিলেন পাঞ্চেত ড্যাম। মন ভাল ছিলনা তাই। ওনার গাড়ি কালো ইনোভা।

মিস্টার রাঘবন। সন্দীপ দে স্কুল জীবনের বন্ধু। নার্সিংহোমের প্রশাসনিক দায় দায়িত্ব বেশিটাই ওনার। কোটি টাকার গড়বর হয়েছে ফান্ডে। কে করেছেন কোনো ধারনা নেই। তবে ডাঃ মল্লিক বা ডাঃ দত্তর করার সুযোগ আছে। সেদিন বিকেলে নিজের সুমো নিয়ে বেরিয়েছিলেন। মুরাডিহ বাজারে মাছ কিনতে গিয়েছিলেন। কাউকে সন্দেহ করেন না। ডাঃ দে মাটির মানুষ ছিলেন।

ডাঃ শ্রীলা রাঘবন। নার্সিংহোমের শুরু থেকেই যুক্ত। টাকা পয়সার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই তাই জানেন না গণ্ডগোলের খবর। ডাঃ সুমনা দত্ত ডাঃ দে-র নেকনজরে ছিলেন কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। মানুষ হিসেবে ডাঃ দে-র তুলনা হয় না। উনি আর মিসেস মল্লিক ওই দিন বিকেলে গাড়ি নিয়ে ঘন্টাখানেকের জন্য বের হয়েছিলেন। গেছিলেন কাছের একটি সাঁওতাল গ্রামে।

স্বপ্না মল্লিক। বিশেষ কিছুই জানা গেল না। সব কিছুই নাকি তাঁর অজানা। সাঁওতাল গ্রামে যাওয়াটা কনফার্ম করলেন।

ধাঁধার বাধা

 

  • কিরে কিছু বোঝা যাচ্ছে?

আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল স্যান্ডি। খানিক আগে সুবীর এসেছিল। জানিয়ে গেল পোস্টমর্টমের রিপোর্ট আজ রাতেই এসে যাবে। প্রভাবশালী মানুষ হওয়ায় এত দ্রুত কাজ হল। কাল মৃতদেহ পাওয়া যাবে। পুলিশই ব্যবস্থা করছে বডি একেবারে কলকাতায় পৌঁছে দেওয়ার। তার মানে অদ্যই শেষ রজনী। কাল সবাই কলকাতা ফিরবে। এদিকে রহস্য তো যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেল। দুপুরে খাওয়ার ঘরে মিসেস দে-র সঙ্গে দেখা। অনেকটাই সামলে নিয়েছেন। স্যান্ডির সঙ্গে কি কথা বললেন। কিছু একটা দিলেনও।

  • কি বললেন মিসেস দে?

  • একটা কাগজ দিলেন। বললেন হাতের লেখা ডাঃ দে-র। বাট মিনিংলেস। যদি আমি সলভ করতে পারি তাই দিলেন।

  • কই দেখি?

স্যান্ডি কাগজটা বাড়িয়ে দেয়। প্যাডের পাতা। তাতে বিচিত্র কিছু ইংরেজি শব্দ। কিছুই বোঝা যায় না। ঠিক যেভাবে লেখা সেভাবেই তুলে দিচ্ছি।

 

Extra caution fatal — please examine vices for kind soul — king’s justice sure : secured — So — just Ignore good judgement — keep extra patience.

 

  • মানে কি?

  • মানেটাই তো খুঁজতে হবে ডার্লিং।

  • অতি সতর্কতা মারণ! এ আবার কি?

  • ইংরেজিগুলোর বাংলা করলে কিছুই পাওয়া যাবে না বলেই মনে হয়। অন্য কোথাও টুইস্ট আছে। ভুলে যাস না রিডল আর শব্দ ধাঁধা ছিল ওনার প্রিয় বিষয়। ডেফিনিটলি এর মধ্যে কোনো প্যাঁচ আছে।

স্যান্ডি কাগজটা একমনে দেখতে থাকে।  একই সঙ্গে ল্যাপটপে খুটুর খাটুর করতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ একমনে ল্যাপটপ ঘাঁটে। তারপর হঠাত্‌ই ল্যাপটপ, কাগজ গুটিয়ে রেখে উঠে পড়ে।

  • বাবলুকে বল বেরবো। সোমেনকেও রেডি হতে বল।

  • হঠাত্‌? যাবিটা কোথায়?

  • যাব পুরুলিয়া সেখান থেকে কলকাতা।

  • মানে?

  • এখানে থেকে কোনো লাভ নেই। বিশ্বজিতদাকে যা বলার বলে দেব।

  • তার মানে স্যন্দিকা মুখার্জি রণে ভঙ্গ দিলেন!

  • ডোন্ট টক রাবিশ। বলেছি এখানে কিছু হওয়ার নেই। যা হওয়ার কলকাতায় হবে। অ্যান্ড আই প্রমিস বাই সানডে মার্ডারার উইল বি অ্যারেস্টেড। কলকাতায় কাল প্রচুর লেগ ওয়ার্ক আছে ডার্লিং।

 

পুরুলিয়ায় এসপি সাহেবের সঙ্গে দেখা করল স্যান্ডি। আমাকে যা বলেছিল একই কথা বলল।

  • তার মানে আপনি ধরে ফেলেছেন কে খুনি?

মিস্টার মিনার প্রশ্নে আলতো হাসে স্যান্ডি।

  • জাস্ট একটা গেস। তবে সেটা মেলাতেই কলকাতা যাব। আপনি প্লিজ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেলে জানাবেন।

  • ও শ্যিওর।

কলকাতার দিকে রওনা হই আমরা। গাড়িতে উঠেই স্যান্ডিকে চেপে ধরি।

  • কিরে, কিছু বলছিস না যে! হঠাত্‌ কি দেখে তুই যবনিকা পাতের ভবিষ্যত্‌বাণী করলি শুনি?

  • সেটা তুইও দেখেছিস।

  • কি?

  • ডাঃ দে-র রিডল।

  • তুই সলভ করে ফেলেছিস! বললি নাতো!

  • তুইও সলভ কর। একটা ক্লু দিচ্ছি। আপেল।

  • আপেল মানে!

জবাব না দিয়ে গম্ভীর হয়ে জানলার বাইরে তাকালো স্যান্ডি। বুঝলাম আর কিছু জানা যাবে না।

জটেশ্বরী

রাত প্রায় বারোটা নাগাদ স্যান্ডি ফোন করল। আমরা কলকাতা ফিরেছি রাত নটা নাগাদ।

  • সাক্ষর, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জানা গ্যাছে।

  • কি বলছে?

  • কোনো ব্লান্ট কিছু দিয়ে মাথার পিছনে আঘাত করা হয়েছে। সেটাই কজ অফ ডেথ। তারপর বডি ফেলে দেওয়া হয়েছে।

  • এতে তোর সুবিধে হল কিছু?

  • নাথিং এক্সট্রা। শোন, কাল আমি অফ নিয়েছি বিশ্বজিতদার কাছ থেকে। তুই অফিস করিস। সন্ধ্যেবেলা দেখা করব।

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কেটে দেয় ফোনটা। এদিকে টেনশনে আমার মাথা ঘুরছে। আবার রিডল-টা নিয়ে বসলাম। না, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। স্যান্ডি এত তাড়াতাড়ি কি করে সলভ করল কে জানে! এর সঙ্গে আপেল-এরই বা কি সম্পর্ক! ভাগ্যিশ আঙুর, কলা, কমলালেবু বলেনি! তাহলে একেবারে ফ্রুট-স্যালাড হয়ে যেত। বেকার মাথা না ঘামিয়ে শুতে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

অফিসে ঢুকতেই চারিদিক থেকে প্রশ্নের ঝড়। হত্যা রহস্যের কী হল? যত বলি আমি নিজেও আঁধারে, কে শোনে কার কথা। শেষে যেটুকু জানতাম তাই বললাম। তারপর শুরু হল স্যান্ডিকে ফোন করার চেষ্টা। একজনকে বারণ করি তো আর একজন করে। তবে জানা যায় স্যান্ডির ফোন সুইচড অফ। বুদ্ধিমতি মেয়ে। সারাদিন কাজের মধ্যে দিয়েই কেটে যায়। অবশেষে সন্ধ্যেবেলা স্যান্ডির ফোন এল।

  • বেরোতে পারবি অফিস থেকে?

  • হ্যাঁ। তোর ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম।

  • অলি পাবে চলে আয়। আজ একটু দারু খাব।

ফোন কেটে দেয়। আচ্ছা মেয়েতো!

অলি-র সামনে পার্ক স্ট্রিটে ওয়েট করছিল স্যান্ডি। দেখেই বোঝা যায় সারাদিন প্রচুর দৌড়-ঝাঁপ করেছে। দোতলায় একটা কোনে টেবিল পেয়ে গেলাম লাকিলি। এ সময়ে জায়গাই পাওয়া যায় না অলিপাবে। স্যান্ডি নিজের জন্য বিয়ার আর আমার জন্য হুইস্কির অর্ডার দেয়। আমি অপেক্ষায় ম্যাডাম কখন মুখ খোলেন। বিয়ার-এ দু তিন চুমুক মারার পর বোধহয় আমার ওপর দয়া হয় স্যান্ডির।

  • সকালে গেছিলাম চাইল্ড অ্যান্ড মেটার্নিটি কেয়ার নার্সিং হোমে। ওরা কলকাতায় পৌঁছনোর আগেই কাজ সারা দরকার ছিল। লাকিলি নার্সিংহোম-এর এক স্টাফ আমার ফ্যান তাই কাজটা সহজ হল। বললাম ডাঃ দে-র উপর একটা ফিচার বানাব তাই রেইকি করতে এসেছি। তবে আপাতত যেন ব্যাপারটা গোপন রাখা হয়।

  • কাজ হল কিছু?

  • কিছু মানে! অনেক কিছু। প্রায় গোটা রহস্যটাই ফাঁস বলতে পারিস। তারপর গেলাম ব্যাঙ্কে।

  • ব্যাঙ্কে? কেন?

  • বিশেষ একটি অ্যাকাউন্ট এর ব্যাপারে খোঁজ করতে।

  • ব্যাঙ্ক তোকে খোঁজ দেবে কেন?

  • এখানেও লাক আমাকে ফেভার করেছে। যে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট তার এক বড় কর্তার সঙ্গে কিঞ্চিত দোস্তি আছে।

হাসতে হাসতে চোখ টিপলো স্যান্ডি।

  • এ কেসটার পুরোটাই তো লাকে-র ভরসায় উতরে গেলি।

  • বাজে বকিস না। লাক না হলে ঘুর পথে করতে হত। তাতে প্রবলেম হত যে সাসপেক্ট টের পেয়ে যেত। তবে সত্যিই যেখানটা লাক কাজ করেছে সেটা কিন্তু ডাঃ দে-র রিডল। ওটা না পেলে আরও দু-একদিন বেশি সময় লাগতো মিস্ট্রি সলভ করতে।

  • আবার রিডল। ওটার হাত থেকে আমায় এবার উদ্ধার কর, ডিয়ার!

আমার কাতর আবেদনেও গলল না স্যান্ডির পাষাণ হৃদয়। উল্টে হাসতে লাগল। আচ্ছা বলুন রাগ হয় না!

  • ব্যাঙ্ক থেকে গেলাম রেসের মাঠে।

  • হুম, এতক্ষনে কেসটা স্বচ্ছ হল।

  • গুড, গুড। এই না হলে রিপোর্টার। বল দেখি।

  • সাসপেক্ট রেসে প্রচুর টাকা হেরেছে। তারপর নার্সিংহোমের ফান্ড থেকে টাকা সরিয়েছে। কিন্তু ডাঃ দে-র কাছে ধরা পড়ে যায়। তাই হত্যাটা করতে বাধ্য হয়।

  • ব্র্যাভো মাই ডিয়ার। পাব্লিক প্লেস না হলে তোকে একটা লম্বা-আ চুমু খেতাম। তা সাসপেক্ট-টা কে সেটা বল।

  • সেটা কি করে বলব! রিডল-এর মানে তো জানিস তুই। আমি তো সলভ করতেই পারিনি।

  • চাপ নিস না। আর তো একটা রাত। কাল বিকেল চারটে-য় নার্সিংহোমে আই উইল ক্লিয়ার এভরিথিং, ডার্লিং।

  • রেসের মাঠ থেকে বেরিয়ে কি আমাকে ফোন করলি?

  • না, আগে লালবাজার গেছিলাম, সেখান থেকে মিস্টার মিনাকে ফোনে ধরলাম। উনিও কাল আসছেন। লালবাজারই দায়িত্ব নিয়েছে কাল নির্দিষ্ট সময়ে সকলকে হাজির করানোর। অ্যান্ড দ্যাটস অল ফর দ্য ডে।

চিচিং-ফাঁক

নার্সিংহোমের ডক্টরস কনফারেন্স রুমে হাজির সবাই। অনেকই যে বেশ বিরক্ত সেটা বুঝতে গোয়েন্দা হওয়ার দরকার নেই। একমাত্র নির্লিপ্ত ডাঃ সুমনা দত্ত। আজ সোমেন ক্যামেরা নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে। কেস সলভ হলেই স্যান্ডি লাইভে দাঁড়াবে। রুমে একধার থেকে বসে ডাঃ মল্লিক, ডাঃ দত্ত, স্বপ্না মল্লিক, ডাঃ শ্রীলা রাঘবন, মিসেস দে, সুমনা দত্ত এবং মিস্টার রাঘবন। উল্টোদিকে লালবাজরের দুই বড়কর্তা আর পুরুলিয়ার এসপি সাহেব। বাইরে সাদা পোশাকের পুলিশ মোতায়েন। সকলের নজরই স্যান্ডির দিকে। স্যান্ডি উঠে দাঁড়ায়।

  • আমি জানি অনেকেই বিরক্ত হচ্ছেন। বাট আই কান্ট হেল্প। আই মাস্ট আনমাস্ক দ্য কালপ্রিট।

একটু থেমে সকলের রিয়্যাকশনটা দেখে নেয়।

  • আপাতদৃষ্টিতে কেসটা জটিল মনে হলেও কালপ্রিট ধরা পড়তই। পুলিশ-ই ধরতে পারত। তবে একটু টাইম লাগত। আমারও লাগত যদি না ডাঃ দে-র শব্দ নিয়ে খেলা করার বাতিক থাকত। আই উইল কাম টু দ্যাট পয়েন্ট লেটার। ডাঃ মল্লিক আমাকে প্রথমেই গুলিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। অবশ্যই ব্যাক্তিগত কারনে। ওনার ম্যাডাম সুমনার প্রতি একটু নেক নজর আছে। তাই ডাঃ দত্ত-র দিকে আমার দৃষ্টি ঘোরাবার চেষ্টা করেছিলেন।

সকলের দৃষ্টি মল্লিকের দিকে। বাকিরা বিস্মিত। সুমনা দত্ত আর স্বপ্না মল্লিকের চোখে আগুনের ঝলক দেখলাম। স্বাভাবিক। সমর মল্লিক অধোবদন।

  • পুরো ব্যাপারটাই হয়েছে টাকার জন্য। সামওয়ান ওয়াজ টেকিং মানিটরি অ্যাডভান্টেজ ফ্রম দ্য নার্সিংহোম। ডাঃ দে সেটা ধরে ফ্যালেন। তাই তাঁকে খুন হতে হল। নাও দ্য কোয়েশ্চেন ইজ হু ইজ হি?

একটু থামে স্যান্ডি। তারপর হঠাত্‌ ডাঃ দত্ত-র দিকে ঘুরে তাকায়।

  • আপনি রেস খেলেন বলেই যে আপনি টাকা চুরি করবেন এটা তো নাও হতে পারে।

  • এক্স্যাক্টলি। আই মিন, সন্দীপকেও তাই বোঝাতে …

হঠাত্‌ থতমত খেয়ে চুপ করে যান ডাঃ দত্ত। প্রচন্ড বিস্মিত মনে হয়।

  • অবাক হবার কোনো কারন নেই। কাল, বিফোর ইউ পিপল রিচ্ড টু কলকাতা আই ওয়াজ ইনভেস্টিগেটিং অ্যাবাউট অল অফ ইউ। সরি আপনাদের চেম্বারেও ঢুকেছি। এবং ব্যাক্তিগত জিনিষ ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। জানেন তো মেয়েদের মাথার ক্লিপ-এর চেয়ে বড় মাস্টার কি আর কিছু হয়না।

এবার অবাক হওয়ার পালা আমার। স্যান্ডি-র এই বিদ্যেটার খবর আমিও রাখতাম না। ডাঃ দত্তকে দৃশ্যতই উত্তেজিত মনে হয়।

  • আই মিন, হাউ ডেয়ার ইউ…

  • ডোন্ট গেট অ্যাঙ্গরি ডক্টর। না হলে রহস্যভেদ করতাম কি করে! তাছাড়া পুরো কথা না শুনে রি-অ্যাক্ট করার ব্যাড হ্যাবিটটাও বদলানো উচিত। তাহলে ডাঃ দে-র সঙ্গে আপনার বেকার ঝগড়াটা হতো না।

  • রেস খেললেই চুরি করতে হবে আই মিন, এর কি মানে আছে?

  • নেই তো। সেটা আমারও কথা, ডাঃ দে-ও আপনাকে তাই বলতে গেছিলেন। বাট আপনি ওনাকে সম্ভবত কথা কম্প্লিট করতে না দিয়েই রিঅ্যাক্ট করে ফ্যালেন। বরোন্তি যাওয়ার আগেই ডাঃ দে জানতেন কে টাকা নয়ছয় করছে। ঘটনা হচ্ছে যিনি করছেন তিনিও রেসের পোকা। বাট আপনারা কেউ জানেন না।

  • মাই গুডনেস, আই মিন কি বলছেন আপনি!

  • আজ্ঞে হ্যাঁ, ডাঃ দত্ত। সম্ভবত ডাঃ দে রেস খেলা মানুষের কি ক্ষতি করে এই সংক্রান্ত কোনো উক্তি করাতেই আপনি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। উনি আপনাকে ব্লেম করতে নয় আপনার পরামর্শ চাইতে গেছিলেন। বাট আপনি…

কথা শেষ করে না স্যান্ডি। ডাঃ দত্ত বিমূঢ়। এই এসি-র মধ্যেও ঘামছেন।

  • এবার আসি মার্ডারারের কথায়। তাঁরও ভয়ঙ্কর রেসের নেশা। বাট কাউকে জানতে দেননি কোনোদিন। আমিও টের পেতাম না যদি না ওনার ড্রয়ারটি খুলতাম। প্রশ্ন হচ্ছে ডাঃ দত্ত-র তো তাহলে জানা উচিত ছিল! উনি রেসের মাঠে নিয়মিত যাওয়া আসা করেন। তাহলে? আসলে আমাদের মাননীয় মার্ডারার মহাশয় মাঠে যেতেন না, অনলাইন বেটিং করতেন। শুধু রেস নয়, ক্রিকেট বেটিং-এও সিদ্ধহস্ত তিনি। মাস আষ্টেক আগে উনি হঠাত্‌ প্রচুর টাকা খুইয়ে বসেন। প্ল্যান ছিল নার্সিংহোমের টাকায় জুয়া জিতে আবার ফেরত দেওয়ার। প্রথম দু মাসে টাকা নিয়েওছেন ফেরতও দিয়ছেন। বাট তারপর-ই শুরু হল লাগাতার পতন। যা সামলে উঠতে পারছিলেন না। এদিকে অডিট-এর সময় এগিয়ে আসছে। তাই ডাঃ দে পেপার্স চেক করতে গিয়েই ওনাকে ধরে ফ্যালেন।

ঘরে পিন পড়লেও শব্দ হবে। সবার চোখ স্যান্ডির দিকে স্থির। একটু জল খায় স্যান্ডি।

  • নাও ওয়ান্স এগেন দ্য কোয়েশ্চেন ইজ হু ইজ হি? এখানেই ডাঃ দে-কে আমার স্যালিউট। সেটা উনি ওনার রিডল-এ বলে গিয়েছেন। খুনি অবশ্য চেষ্টা করেছিল যাতে ক্লু না থাকে বাট খুনির সাহায্যকারীর বুদ্ধিতে রিডল-এর মানে ধরা না পড়ায় কাগজটাকে ইগনোর করেন। যেটা মিসেস দে আমাকে দেন। তবে হ্যাঁ, খুনির সাহায্যকারী কিন্তু পার্টনার ইন ক্রাইম নন। জাস্ট ঘটনাটা জেনে নিরুপায় হয়ে হেল্প করতে রাজী হন। এবার বলি ডাঃ দে-র শব্দ-জব্দের মানে। “আমি জানি। কে করেছে। এ রঘুর কাজ”। ওকি মিস্টার রাঘবন। পিস্তল বার করার চেষ্টা একদম করবেন না।

রাঘবন পকেটে হাত ঢুকিয়েছিল। সেই অবস্থাতেই এসপি মিনা আর লালবাজারের হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের ডিসি দুদিক থেকে চেপে ধরেছেন। রাঘবনের কালো মুখ রাগে বেগুনি।

  • মিস্টার মিনা। রাঘবনের কেবিন সার্চ করে আর নার্সিংহোমের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ডিটেইলস থেকে আমি যা বললাম তার প্রমাণ পাবেন। তবে জানি না কনভিকশনের জন্য এগুলো এনাফ কিনা?

  • থ্যাঙ্ক ইউ স্যন্দিকা ম্যাডাম। ইউ হ্যাভ ডান আ ফ্যাবুলাস জব। উই উইল রিমেন গ্রেটফুল টু ইউ। পুলিশ জানে কিভাবে চার্জশিট পেশ করতে হবে।

মিস্টার মিনার চোখে মুখে কৃতজ্ঞতা। ঘরের প্রায় সকলের চোখেই স্যান্ডির প্রতি সম্ভ্রম।

ব্রেকিং, লাইভ সব মিটতে মিটতে প্রায় রাত আটটা। প্ল্যনিং ছিল আজও স্যান্ডিকে নিয়ে অলিতে যাব। আজ আমার ট্রিট। কিন্তু তার আগেই বিশ্বজিতদার নির্দেশ হাজির। যত রাতই হোক অফিস ঘুরে বাড়ি ফিরতে হবে। স্বাভাবিক। বিশ্বজিতদারও ভাত হজম হচ্ছে না। অফিসে ঢুকতেই স্যান্ডি অভিনন্দনের বন্যায় ভেসে গেল। তবে কেউ কিছু জানতে চাইলো না। রিশেপসন আমাদের দেখেই জানিয়ে দিল সোজা চিফ এডিটরের ঘরে যেতে হবে। বুঝলাম কেন কেউ কিছু জিগ্যেশ করল না। বিশ্বজিতদার ঘরে ঢুকতেই চমক। ঘরে বসে মিস্টার মিনা। আমরা ঢুকতে না ঢুকতেই চারজনের জন্যে কফি হাজির। এটাও বুঝলাম আমার বস সব প্ল্যান করেই রেখেছেন। তবে সবার আগে স্যান্ডিই রিঅ্যাক্ট করল।

  • দাদা আমি সব বলতে রাজি। কিন্তু সোমেনকেও ডাকতে হবে। হি ওয়াজ পার্ট অফ আওয়ার টিম। নাহলে আমি একটি কথাও বলব না।

স্যান্ডির এই প্রতিক্রিয়াটা আমার খুব ভাল লাগলো। বিশ্বজিতদা কোনো কথা না বলে ইন্টারকমে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। সোমেন, আর একটি চেয়ার এবং আর এক কাপ কফি হাজির হলো। এবার স্যান্ডির মুখে হাসি ফুটলো।

  • কি ব্যাপার মিস্টার মিনা, আপনি?

  • কি করি স্যন্দিকা ম্যাডাম। আপনি তো ফ্ল্যাট করে দিয়েছেন। আপনি কাল যা যা করেছেন তা সব পুলিশের রুটিন ওয়ার্ক। দুদিন পরে হলেও আমরাও করতাম। কিন্তু বরোন্তি-তে আপনার গেস ওয়ার্ক আর ওই রিডল-এর ব্যাপারটা না জানলে যে আমার ঘুম হবে না ম্যাডাম।

  • প্লিজ স্যান্ডি এবার শুরু কর।

কাতর অনুনয় বিশ্বজিতদারও।

  • প্রথমেই বলি সাক্ষর সঙ্গে না গেলে আই কুডন্ট হ্যাভ ডান ইট। ও, নট ওনলি ওয়াচড মাই ব্যাক, ওর ইনপুটস ছাড়া আমাদের রিপোর্টিং-গুলো এতো ভাল হত না। আর অবশ্যই সোমেন। ও ছাড়া এত ভাল ছবি কে দিত?

আসল কথা শোনার জন্য সবাই তখন উদগ্রীব।

  • রহস্যের বাকিটা সবারই জানা। সকলের প্রশ্ন শুধু রিডল নিয়ে। সাক্ষর আর সোমেন দেখেছে। বাট দে কুডন্ট সলভ ইট।

ও কাগজটা টেবিলের উপর রাখে। বিশ্বজিতদা আর মিস্টার মিনা মন দিয়ে দেখতে থাকেন।

  • কি মিস্টার মিনা, সলভ করবেন নাকি? বিশ্বজিতদা?

  • তুমিই বলো।

দুজনেই সমস্বরে বলে ওঠেন।

 

 

Extra caution fatal — please examine vices for kind soul — king’s justice sure : secured — So — just Ignore good judgement — keep extra patience.

  • কি বুঝছেন?

সবাই চুপ। আমি তো প্রায় পাগল।

  • ওকে আমি-ই বলছি। প্রথমেই বলি একথাগুলোর কোনো মানে হয় না। প্রথমত এত ভুল ইংলিশ ডাঃ দে নিশ্চয় লিখবেন না। দ্বিতীয়ত, ক্যাপিটাল আর স্মল লেটারের গোঁজামিল। প্রথম সেন্টেন্স-এর এক্সট্রার E টা ক্যাপিটাল। আবার পরের দুটো সেন্টেন্সের ফার্স্ট ওয়ার্ডের ফার্স্ট লেটারগুলো স্মল। তারপর শুধু সো শব্দটার S ক্যাপিটাল। আবার জাস্ট ইগনোরের I টা হঠাত্‌ ক্যাপিটাল। এবার পরের প্রশ্ন। উনি প্রতিটা সেন্টেন্সকে হাইফেন বা ড্যাশ দিয়ে আলাদা করেছেন। রাইট? কিন্তু শ্যিওর আর সিকিওর্ড-এর মাঝে কোলন কেন? তার মানে ওটাও একটা ক্যারেক্টার। সোজা কথায় উনি প্রাচীনতম কায়দা ব্যবহার করেছেন। যেখানে পুরোটাই ক্যামোফ্লাজ শুধু প্রথম অক্ষরগুলোই সত্যি। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? Ecf pevfks kjs:s S jIgj kep। কিন্তু এর মানে কী? হঠাত্‌ মাথায় এলো ডাঃ দে-র ঘরে দেখেছিলাম উনিও ম্যাকবুক প্রো ইউজ করেন আমার মতন। এটা কি তবে অন্য ভাষার কি ওয়ার্ড অ্যাকর্ডিং টু ম্যাকবুক! যেহেতু উনি বাঙালি। তাই প্রথমেই আমি আমার ল্যাপটপে বাঙলায় এই কিগুলো টাইপ করলাম। কি বেরোলো দেখবেন? E=আ c=ম f=ি। অর্থাত “আমি”। এবার দেখুন। p=জ, e=া, v=ন, f=ি, k=ক, s=ে। k=ক, j=র, s=ে, :=ছ s=ে। S=এ, j=র, I=ঘ, g=ু, j=র। k=ক, e=া, p=জ। তার মানে দাঁড়ালো- “আমি জানি। কে করেছে। এ রঘুর কাজ।” মিস্টার রাঘবনকে স্কুল জীবন থেকেই যে ডাঃ দে রঘু বলে ডাকতেন এটা জানার জন্য পুলিশ বা গোয়েন্দা কারুরি দরকার নেই। সেটা সবাই জানে, তাই না?

  • ও তাই তুই আমাকে ক্লু হিসেবে আপেল বলেছিলিস! অ্যাপেলের ল্যাপটপ বলে। আর আমি তো ফ্রুট স্যালাড ভাবতে বসেছিলাম।

সবাই হেসে ওঠে। স্যান্ডি একচুমুকে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কফিটা শেষ করে। এবার কথা ফোটে মিস্টার মিনার।

  • স্প্লেন্ডিড, ম্যাডাম।

  • কিন্তু রাঘবনের সহকারী-র ব্যাপারে তুই কি বলছিলিস?

প্রশ্নটা না করে থাকতে পারিনা।

  • মিস্টার রাঘবন ওনার স্ত্রীকে ফাঁকি দিতে পারেননি। তাই মরিয়া হয়ে স্ত্রীর সাহায্য চান। মিসেস দে-কে দেখভালের সুবাদে ডাঃ শ্রীলা-র সুযোগ-ও ছিল ডাঃ দে-র কাগজপত্র ঘাঁটার।

হঠাত্‌ বিশ্বজিতদা আমার দিকে ঘোরে।

  • সাক্ষর, স্যন্দিকা-কে এবার একটা প্রোমোশন দিতেই হয়। কি বলো?

  • দাদা, তাহলে ওকেই চিফ রিপোর্টার বানিয়ে দিন। আমি রেজিগনেশন দিয়ে দিচ্ছি।

সমবেত হাসিতে চিফ এডিটরের রুম কেঁপে ওঠে।

অন্য ডুয়ার্স

পোরা পোড়া নয়

কোথায় যাচ্ছি? কেন যাচ্ছি? কিছুই জানি না। রাজদা বলল, চলো রাজা। আমিও এক পায়ে খাড়া। শেষে ট্রেন ছাড়ার পর আর থাকতে না পেরে জিগ্যেশ করেই ফেললাম, “রাজদা, একটু বলবে প্লিজ, চলেছি কোথায়?”

  • তুমি তো নতুন জায়গায় বেড়াতে যেতে চেয়েছিলে, সেখানেই যাচ্ছি।

  • বুঝলাম। জায়গার নাম না হয় উহ্যই থাক। কিন্তু সেখানে আছেটা কী?

  • কী চাও তুমি? প্রথমেই বলে দিই যা চাও তা হয়তো পাবে না। তবে যা পাবে সেটা চাওয়ার থেকে কম না বেশি সে বিচারের ভার তোমার ওপরেই ছাড়লাম। আর পরিচিত হবে অনেক মানুষের সঙ্গে।

ভ্রমণ সাংবাদিকতা শুরু করা ইস্তক, এর আগে পর্য্যন্ত এমন অনিশ্চয়তায় পড়িনি কখনো। গোড়া থেকেই শুরু করা যাক। বেশ কিছুদিন বের হওয়া হয়নি কোথাও। লেখার রসদেও টান পড়েছে। একদিন গল্পের ছলে হেল্প ট্যুরিজমের রাজ বসু-কে জানালাম মনের কথা। রাজদা খালি হেসে বলেছিলো, “দেখা যাক।”

ভরা বর্ষা। তখন আছি শিলিগুড়িতে। এক বর্ষণমুখর সকালে হঠাত রাজদার ফোন, “দুপুরে অফিসে এসো। কাল ভোরেই বেরবো দিন চারেকের জন্য।”

বোঝো!

পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় বৃষ্টি মাথায় বেরিয়ে পড়া। রাজদা, সঙ্গে তাঁরই এক বন্ধু সুনীলজী। (পরে জানা গিয়েছিল পুরো নাম সুনীল চহ্বান। নিবাস সিমলা। আদি বাড়ি হিমাচলেরই স্পিতি। নেশা ঘুরে বেড়ানো আর ফোটোগ্রাফি)। প্রাথমিক গন্তব্য এনজেপি। সেখান থেকে অসমগামী কামরূপ এক্সপ্রেস। ট্রেন ছাড়ার পরেই উপরিউক্ত কথোপকথন।

ট্রেনের চাকা গড়ায়, আসতে আসতে খোলসা হয়। চলেছি ডুয়ার্স। তবে পশ্চিমবঙ্গে স্থিত ডুয়ার্স নয়, অসম-এর ডুয়ার্স। ভারত সংলগ্ন ভুটানের ১৮টি দুয়ারের ৮টি-ই সেখানে। যা পৃথিবীর সব থেকে বৈচিত্রময় অরণ্যে উন্মুক্ত। মানস বায়োস্ফেয়ার। যেটি একাধারে জাতীয় উদ্যান, টাইগার রিজার্ভ, এলিফ্যান্ট রিজার্ভ এবং অবশ্যই ইউনেস্কো স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ব্যস আর পায় কে! আহ্লাদিত এবং বিগলিত মন ট্রেনের সংগে পাল্লা দিয়ে ডুয়ার্সের কোলে।

বিস্তীর্ন ডুয়ার্স অঞ্চল, ইংরেজরা এ দেশে আসার আগে ছিল ভুটান রাজাদের সম্পত্তি। কিন্তু বণিক ইংরেজরা এ অঞ্চলে পা দিয়েই ভৌগলিক ভাবে এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে। স্বাভাবিক ভাবেই লাগে ভুটান রাজার সঙ্গে বিবাদ, যার পরিণতি যুদ্ধ। অবশেষে ১৮৬৫-র সিঞ্চুলা চুক্তিতে যুদ্ধের অবসান হল, তবে ডুয়ার্সের দখল ইংরেজদের হাতে আসার পর। এ ইতিহাস জানা। কিন্তু পরবর্তিতে পদে পদে একথা মনে করতে হবে ভেবে মহাপুরুষদের বাণী স্মরণ। অধিকন্তু ন দোষায়ঃ।

মিনিট দশ বিফোর টাইম কামরূপ এক্সপ্রেস ঢুকলো নিউ বঙ্গাইগাঁও স্টেশনে। তখন সকাল সাড়ে এগারোটা। প্ল্যাটফর্মে আলাপ হল আমাদের রিসিভ করতে আসা রাজদার আর এক বন্ধু সৌম্যদ্বীপ দত্ত-র সঙ্গে। ইনি অসমিয়া ভাষায় বিখ্যাত ভ্রমণলেখক। শুধু ভ্রমণ নয়, বিষয় বৈচিত্রও অবশ্য অবাক করার মতন। সেসব যথাস্থানে। প্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরে আসতে গিয়ে ওভারব্রিজ পেরোতে হয়। তার উপর উঠতেই মন ভাল হয়ে গেলো। কালো মেঘে ঢাকা আকাশ। সামনে আর ডাইনে ছোটো ছোটো টিলা পাহাড়ে গা জড়াজড়ি। এগুলো যে হিমালয়ান রেঞ্জ নয় সে তথ্য টুক করে জানিয়ে দিল রাজদা।

প্রথম গন্তব্য অভয়াপুরী। স্বাধীনতার আগে এই অঞ্চলে অনেকগুলি ছোটো ছোটো স্বাধীন জমিদারী বা রাজত্ব ছিল। তারই একটি। প্রসঙ্গত বলা যায় কাছেই গৌরিপুর অঞ্চলের রাজা ছিলেন বিখ্যাত হাতি বিশেষঞ্জ লালজী বরুয়া বা প্রকৃতীশ বরুয়া। যিনি প্রখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যাক্তিত্ব প্রমথেশ বরুয়ার ভাইও। আপাতত অভয়াপুরী বঙ্গাইগাঁও জেলার অন্তর্গত। যা একসময় ছিল গোয়ালপাড়া জেলার অংশ। স্বাধীনতার আগে অবশ্য গোয়ালপাড়া নিজেই ছিল রংপুর জেলার অংশ।

অভয়াপুরী একটি ছিমছাম ছোটো জনপদ। টিপিক্যাল পর্যটকের চোখে আপাতদৃষ্টিতে কিছুই নেই। তবে চমক অপেক্ষা করেছিল। ততক্ষণে মেঘ কেটে রোদ। সঙ্গে চিটপিটানি গরম। ঘামে গা চুলকোয়। জানা গেল অক্টোবর থেকে মার্চের শেষ, এখানকার আবহাওয়াই ভীষণ মনমুগ্ধকর। এটা অগাস্টের শুরু। সৌম্যদার প্রস্তাব একটু দই কিনে নিয়ে গেলে হয়। টক দই। তার আগে বলি অসমে প্রবেশ ইস্তক, বাঙলা হরফে লেখা পড়তে গিয়ে বিষম লাগার কথা। যেমন চিল্ক (সিল্ক), চিমেন্ট (সিমেন্ট) প্রভৃতি। সব থেকে চমকপ্রদ ‘ইয়তে ভাত পোরা যায়’। এবারে চমক ‘গাখীরা’। আর থাকা গেল না। প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো। সৌম্যদা খুব যত্ন নিয়েই জানালেন সব। আমরা চ কে চ পড়লেও অসমিয়া ভাষায় সেটা স। পোরা টা এ ভাষায় পোবা (পোওয়া), যার মানে পাওয়া। অর্থাত হিন্দির মতন ব আর পেট কাটা ব, দুটোর উচ্চারণই আছে। বাঙলায় দুটো ব থাকলেও আলাদা উচ্চারন নেই। তবে এ ভাষায় ব এর পেট কাটলে সেটা র হয়। জল মেশালেও যা ডাইলুট হওয়ার নয়। আমাদের র এখানে ওয় উচ্চারিত। গাখীরা মানে গরুর দুধ। গা অর্থে গরু, খীরা অর্থে ক্ষীর আসলে দুধ। এখানে গম্ভীর হয়ে ফান্ডা ঝাড়তে গিয়ে মুখ পুড়ল।

  • ও, ঠিকই তো। যেমন অসম আসলে অহম।
  • না, এটাও ভুল। ওটার উচ্চারন অখ্অম।

  • অখম?

  • না, অখ্অম।

অনেকবার লাগল ব্যাপারটা বুঝতে। পাঠক হয়তো বানানের তারতম্যে একেবারেই বুঝেছেন। পরবর্তীতে এরকম পদে পদে ঠেকা খেয়ে উপলব্ধি গাঢ় হয়েছিল।

নিঝুমপুরী নিগমঘোলা

ঠিক যখন ভাবতে শুরু করেছি নিজের মনে, এ কোথায় এলাম! হ্যাঁ, ছিমছাম জনপদ। কিন্তু চোখ জুড়নো প্রকৃতি কই, কিম্বা শিরদাঁড়া টানটান করা ইতিহাস! তখনই, হ্যাঁ, তখনই যেন জাদুবলে আবির্ভুত ময়-পুরী। অভয়াপুরী সংশোধনাগারের পিছনেই সবুজে মোড়া এক আস্তানা। আস্থা নেচার্স হোম অ্যান্ড ডেয়ারি। যে ডেয়ারির নিজস্ব উত্‌পাদন দই, কেনা হল খানিক আগেই। ফেসবুকের ফার্মভিলে যেন বাস্তব রূপে সামনে হাজির। মাঝামাঝি একটা দোতলা কটেজ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে একতলা আরও কয়েকটা। সামনেই বাঁধানো জলাধার। একঝাঁক হাঁস চড়ে বেড়াচ্ছে। মহানন্দে কলরব করে। জলাশয়ের অপর পাড়ে সারি দেওয়া গামার গাছ। পুরোটাই প্লান্টেশনের ফল। যার পিছনেই উঁকি মারে সবুজে ছাওয়া এক টিলা পাহাড়। সবুজের যে এত রকমফের হয় বর্ষায় এখানে না এলে জানাই হত না। এই রিসর্ট এলাকা এবং তার বাইরের জলাজমি আর পাহাড় সহ মোট দুহাজার হেক্টরের মালিক শৈলেশ চৌধুরি। নিজেই হাজির আপ্যায়নে। একদিকে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা, অন্যদিকে ফার্ম হাউজ। যেখানে গরুর সংখ্যা প্রায় দুশো। ব্যাপার স্যাপার দেখে বাকরহিত। তবে চমকের আরও বাকি ছিল। জানা গেল শৈলেশবাবু নিজে একসময় ছিলেন শিকারি। তারপর উপলব্ধি করেন বন ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা। তাই প্রকৃতিকে বাঁচাতে আসপাশের গ্রামের মানুষদের সংঘবদ্ধ করে এই উদ্যোগ। যা শুধু অভয়াপুরীতেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং কাজের পরিসর বাড়িয়েছেন জেলার বাইরেও।

এখানেই রাজ বসু, সৌম্যদ্বীপ দত্ত আর শৈলেশ চৌধুরি এই ত্রয়ীর সম্মিলিত ভূমিকাটা ছোট্ট করে বলে নেওয়া দরকার। লোয়ার অসমের বিস্তীর্ন অঞ্চল জুড়ে প্রায় পঁচিশ বছর ধরে কাজ করে চলেছেন এঁরা। প্রাথমিক ভাবে একক প্রয়াস, পরবর্তীতে যৌথ উদ্যোগ। পরের চারদিন ধরে যেটা বুঝলাম অন্তরের অন্তস্থলে। এক কথায় পর্যটনের প্রসার বললে এ কাজকে খাটো করে দেখা হবে। বরং বলা ভাল একটা নির্দিষ্ট দর্শনের অভিমুখে এই যাত্রা।

দুপুরের ভুরিভোজ সেরে বেরনো হল সাইট সিইং-এ। ঠিক কেতাবি সাইট সিইং নয়। বরং বলা ভাল, খুঁজে পাওয়া, প্রকৃতির সাথে স্থানীয় জনজীবনকেও। রিসর্টে থাকতেই নানান পাখির উপস্থিতি টের পাওয়া গিয়েছিল। যেমন ব্ল্যাক হেড ওরিয়ল, ট্রি পাই, স্পটেড মুনিয়া। সৌম্যদা জানালেন, বার্ড ওয়াচারদের জন্য এ এলাকা স্বর্গরাজ্য। শাল, সেগুন, গামারির জঙ্গলকে একপাশে রেখে গাড়ি চলল টিলা পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে আঁকাবাঁকা পথ ধরে। রাস্তার বাঁ দিক বরাবর বিস্তীর্ন জলাভূমি।

  • এই জল কি বর্ষার কারনে?
  • কিছুটা তাই। তবে এটা একসময়ের নদী। খাত বদলে গেলেও বিস্তীর্ন অঞ্চল জলাভূমি হয়েই রয়ে গিয়েছে। স্থানীয়রা বলে মরা মানস। এক সময় মানস নদীর গতিপথ ছিল।

গাড়ির সামনের সিট থেকে ঘাড় না ঘুরিয়েই আমার কৌতুহল নিরসন করলেন সৌম্যদা।

অবশেষে পৌঁছলাম খোরাগাঁও গ্রামপঞ্চায়েত এলাকায়। ছোট্ট এই গ্রামের নাম গেরামারি। শুনেই সৌম্যদার মন্তব্য, তার মানে আগে এখানেও গন্ডার আসত। গন্ডার মারা থেকেই গেরামারি নাম। রাজবংশী গ্রাম। যেখানে গাড়ি থামল তার সামনেই ডাল পালা বিস্তার করে এক প্রাচীন বটবৃক্ষ। যার উপর গ্রামের ছোটোদের খেলাধুলা আর পাশেই চাতালে গাঁও-এর বুড়োদের বৈকালিক আড্ডা। ডালপালা বিস্তৃত শুনে যদি শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের অনুষঙ্গ মনে আসে তাহলে এই মুহুর্তে তা বাতিল করা উচিত। আকারে বিস্তারে তার সঙ্গে এর কোনো তুলনাই হয় না। কিন্তু একটা জায়গায় এই গাছের বিশিষ্টতায় আছে নিজস্বতা। প্রকৃতি প্রেমিক হলে তাই এ স্থান অত্যন্ত পবিত্র। কারন নির্বিচারে গাছ কাটার যুগে, কোনো সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই, স্থানীয় মানুষের উদ্যোগেই টিকে গিয়েছে এই বটগাছটি।

সৌম্যদা তখন স্থানীয় ভাষায় বুড়োদের সঙ্গে গল্প জুড়েছে। সবটা না বুঝলেও মন দিলে খানিকটা যেন বোঝা যায়। তা থেকে এবং পরে জিগ্যেশ করে কয়েকটি তথ্য জানা গেল। বেশ চমকপ্রদ। এঁরা নিজেদের হিন্দু বলে দাবী করেন। কিন্তু এঁদের আরাধ্য দেবতারা হলেন এই বটগাছ, মনসা, গণেশ। তবে এদের ধর্মাচারণে বলির কোনো স্থান নেই। সৌম্যদার ব্যাখ্যা, এরা আসলে একসময়ে ছিলেন বৌদ্ধ। মহাযানী বৌদ্ধধর্মে এমন অনেক দেব-দেবীর উল্লেখ আছে যা হিন্দু ধর্মেও পূজিত। যেমন গণেশ বা তারা। আসলে এদের বেশিটাই লৌকিক দেব দেবী। আর বট গাছ বা বোধিবৃক্ষ তো বৌদ্ধ মাত্রই পরম পবিত্র। সৌম্যদার সাম্প্রতিকতম গবেষণার বিষয়ও তাই। কিন্তু যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল, সেটা হল এই মানুষগুলির মধ্যেকার বিভ্রান্তি। উত্তরবঙ্গের রাজবংশীদের মতন এঁরা নিজেদের শিকড় সম্পর্কে খুব একটা নিশ্চিত নন। কেমন যেন সন্দিহান। ঠিক কোনটা, ভূল কোনটা এ নিয়ে খানিক যেন দোনামোনা ভাবও আছে। আসলে ইতিহাসই দায়ী এর জন্য। পুরনো রাঙামাটির বিস্তীর্ন উত্তর এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ছিল রাজবংশীদের এলাকা। তারপর রাঙামাটি ভেঙে হল রংপুর। মোটামুটি ভাবে রাজবংশী অধ্যুষিত অঞ্চল। এরপর Radclif সাহেবের বদান্যতায় রাজবংশীরা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লেন। এক অংশ পেল বাংলাদেশের নাগরিকত্ব, বাকি দুই অংশের ঠাঁই হল যথাক্রমে পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমে। মূল ভাষা এক থাকলেও বিভাজন হল সেখানেও। ভাষাভিত্তিক এবং বলা ভাল হরফভিত্তিক। পাঠক হয়তো জানেন ইংরেজরাই গ্রেটার অসমে বাংলা ভাষাকে প্রধান দেশীয় ভাষা হিসেবে চালু করে। যার প্রভাবে অসমিয় হরফে বাংলার হরফের গভীর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মোটকথা একটা চরম দড়ি টানাটানির দাম দিতে হল রাজবংশীদের। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন যাঁরা, তাঁরা নিজের শিকড়কেই ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলতে লাগলেন।

পরের গন্তব্য গণেশ মন্দির। খানিক আগের ধর্মভিত্তিক ধাঁধাটার সমাধান হল এখানে এসে। প্রায় বারো’শ বছরের পুরনো মন্দির। আনুমানিক এক হাজার থেকে এগারো’শ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বক্তিয়ার খিলজির সেনাবাহিনীর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। সম্প্রতি স্থানীয় মানুষ একটি গণেশের মূর্তি উদ্ধার করেন এখান থেকে। তারপর হিন্দু দেবতা হিসেবে নতুন মন্দির নির্মান করে সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। আসল মন্দিরের যে ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার হয়েছে, তার থেকে যে তথ্যগুলি জানা যাচ্ছে তা কিন্তু ইঙ্গিত দিচ্ছে, যে এটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল। প্রথমত এর গঠনশৈলি। যা নির্দেশ করে এটি পাল রাজাদের আমলে তৈরি। যাঁরা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। দ্বিতীয়ত রাজা ধর্মপালের বিখ্যাত ট্রেডমার্ক ধনুষ-খিলানের উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয়, সম্ভবত তাঁর আমলেই নির্মিত এ মন্দির। আর তিন নম্বর, মন্দিরটির প্রবেশ দ্বার পূবমুখি। যা হিন্দু মন্দিরের ক্ষেত্রে হয় না। যেমন নতুন মন্দিরটি কিন্তু পশ্চিমমুখি। যেহেতু দেবতা হিসেবে গণেশের উল্লেখ মহাযানী বৌদ্ধধর্মে পাওয়া যায় তাই সৌম্যদা আর রাজদা স্থির সিদ্ধান্তে, এটি বৌদ্ধমন্দিরই ছিল। পরে গণেশের মূর্তিটি দেখে সেই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হওয়াই স্বাভাবিক।

সেখান থেকে বেরিয়ে পরের গন্তব্যের দিকে রওনা। খানিকটা এন এইচ ৩৭, খানিকটা এন এইচ ৩১ ধরে এগনোর পর গাড়ি ঢুকলো ডানদিকে। অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তা। কিছুটা ওঠা, কিছুটা নামা। চারিদিকে টিলারা সব ঘনিয়ে আসে। জানা গেল ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় অবস্থিত এই সব টিলা পাহাড়ের গড় উচ্চতা মাত্র বারো থেকে চোদ্দ’শ ফিট। এ অঞ্চলের সব থেকে উঁচু টিলাটি, মাত্র আঠারো’শ ফিট উঁচু। যেটা আমরা পরের দিন দেখব।

নিগমঘোলা। এক সময় এই অঞ্চলে ছিল বাঙলা ভাষাভাষি মানুষের বাস। প্রকৃতির নির্জনতার কারনে জায়গার নাম হয় নিঃঝুম গোলা। পরে যা অপভ্রংশ হয়ে দাঁড়ায় নিগমঘোলায়। গোলা বা ঘোলা অর্থ চারিদিক পাহাড় বেষ্টিত সমতল স্থান। মানে বলে না দিলেও চলত। মুখের কথা আটকে গিয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরলে চোখে পড়বে ঢেউ খেলানো টিলার সারি। যেন প্রকৃতি আপন খেয়ালে মাঝের সমতলকে ঘিরে দেওয়াল রচনা করেছে। যার মাথায় অস্তগামী সুর্য আর বাদল মেঘের লুকোচুরি। রাজদা জানাল, এই জায়গাকে ধুরা হিসেবে ব্যবহার করা হত।  ধুরা মানে হাতি ধরার জায়াগা বা এলিফ্যান্ট ক্যাম্প। একসময় নিজেদের প্রয়োজনে ইংরেজরা গৌরিপুরের রাজা লালজী বরুয়াকে বরাত দিয়েছিল জঙ্গলি হাতি ধরে প্রশিক্ষিত করার। শুধু অসম নয়, পূর্ব হিমালয় সংলগ্ন বিস্তীর্ন অঞ্চলে লালজী এরকম অনেকগুলি ধুরা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অনেকেরই হয়তো খেয়াল আছে মিরিক-এর পথে গাড়িধুরা নামে একটি জায়গা আছে। সেটিও লালজীর ক্যাম্প ছিল। বন্য হাতিকে তাড়িয়ে নিয়ে আসা হত এই প্রাকৃতিক দেওয়ালের ফাঁদে, তারপর তাকে ধরে প্রশিক্ষিত করা হত। এ কাজে সাহায্যের জন্য লালজী গারোদের কাজে লাগাতেন। প্রধান হাতি ধরিয়েকে বলা হত ফান্দি। গারোরা ভাল ফান্দি হতে পারত।

আগে এখানে বাঙলা ভাষাভাষির মানুষ থাকলেও এখন এটি সম্পূর্ণ গারো অধ্যুষিত গ্রাম। সমতলে বছরে একটাই চাষ। সৌম্যদার তথ্য অনুযায়ী, বর্ষাকাল ছাড়া এখানে জলের কোনো উত্‌স নেই। এমনকি মাটির নিচের জলও মেলে না বললেই চলে। তাই বর্ষার মরশুমে ধানের চাষ ছাড়া এখানকার প্রাকৃতিক ফসলকে কৃষি কাজে বদলেছে গারোরা। সেগুলি হল আনারস, কমলালেবু, কলা আর অসমের বিখ্যাত তাম্বুল অর্থাত্‌ সুপারি। এই গ্রামে আপাতত দেড়’শ ঘর অধিবাসীর বাস। তাদেরই একটা বড় অংশ এগিয়ে এসেছেন প্রকৃতি সংরক্ষণের কাজে। সেই কাজকে অর্থনৈতিক ভাবে সফল করার দায়িত্ব নিয়েছেন আমার সঙ্গীরা। চৌধুরিদার সহায়তায় পাহাড়ের ঢালে তৈরি হয়েছে দিব্যি এক নির্জন গাছবাড়ি। এক রাত কাটিয়ে যাওয়ার লোভনীয় হাতছানি উপেক্ষা করা বেশ কঠিন। আমারও ইচ্ছে ছিল থাকার, কিন্তু বর্ষার কারনে সে ইচ্ছেয় সমবেত বাধা পড়ল। আতিথেয়তায় এগিয়ে এলেন গাঁওবুড়া সুবিন মারেক। না, পর্যটন ব্যবসায় একটি পয়সার আমদানি তাঁর হয় না। চানও না। শুধু এলাকাটা বাঁচবে, মানুষ জানবে, আর তিনি বিভিন্ন মানুষের সাথে মিশতে পারবেন, এই তাড়নাতেই গ্রামের একটা বড় অংশকে নিয়ে তিনি এই কর্মযজ্ঞের অংশীদার। আফশোষ করলেন থাকবনা শুনে। আমাদের আপ্যায়নে নিজেদের ট্র্যাডিশনাল ডিশ খাওয়ানোর কথা নাকি ভেবেছিলেন। দোখাপ্পা। ডুমুরের পাতায় জড়িয়ে বিশেষ প্রণালিতে রাঁধা মাংসর পদ। একেবারে গারো ঘরানার। সঙ্গে পানীয়, সু। আদতে রাইস বিয়ার বলা চলে। ভেবেছিলাম জিভের জল জিভেই রইল। কিন্তু ভুল প্রমান করতেই যেন এগিয়ে এলো লক্ষী মারেক। অষ্টাদশী গারো সুন্দরী। প্রথমে হাতে হাতে তুলে দিল গ্লাস ভর্তি সুস্বাদু সরবত্‌। শুনলাম কাঁচা কমলালেবুর খোসা দিয়ে তৈরি! এরপর এলো এখানকার বিখ্যাত মালভোগ কলা। শেষ হতে না হতেই মিষ্টি আনারসের স্বাদে মন ভরে গেল। তারপর এক বিচিত্র স্বাদের পিঠে। হ্যাঁ, পিঠে। ওদের ভাষায় পিঠা। নোনতা, মিষ্টি, ঝাল সব স্বাদেই ভরপুর। উপকরণ? অনেক পেড়াপেড়ির পর জানা গেল। চাল গুঁড়ো, বেসন, পেঁয়াজ, আলু, গুড় বা চিনি আর…, না আরটা ভাঙল না লক্ষী। ট্রেড সিক্রেট। কিন্তু মন জিতে নিয়েছে ততক্ষনে। তারপর চা আর সব শেষে পরম যত্নে এগিয়ে ধরল রূপালি বাটা। যাতে আছে কাটা পান, কৌটায় চুণ আর অবশ্যই জলে ভেজানো তাম্বুল। অনেকেই নিল, আমি সাহস করলাম না। পুরনো এক অভিজ্ঞতা মনে পড়ায়।

ইচ্ছে না করলেও নেমে আসা আঁধারের ভ্রূকুটিতে অভয়াপুরীর পথ ধরতেই হল। মনে মনে বললাম, আবার আসব লক্ষী। থেকে যাব তোমাদের আতিথেয়তায় গাছবাড়িতে একটা রাত।

ভূমিপুত্ররা

সারাদিনের চিটপিটে গরমের পর সন্ধে গড়াতেই নামল বেজায় বৃষ্টি। বৃষ্টির ছাঁটে শরীর জুড়োতে জুড়োতে খাওয়ার ঘরের বাইরের বারান্দায় বসল জমিয়ে আড্ডা। আমরা পঞ্চ-পান্ডব তো ছিলামই সঙ্গে যোগ দিলেন আর একজন। দে-দা। পুরো নাম এন কে দে। বঙ্গাইগাঁও রিফাইনারির কর্মী। রাজদা এসেছে শুনে দেখা করতে হাজির। ভাগ্যিশ! না হলে সর্ব অর্থে রসিক এই মানুষটির সঙ্গে পরিচয় হত না। একাধারে খাদ্য রসিক, আড্ডাবাজ আর তার সঙ্গে অসম্ভব জঙ্গলপ্রেমী। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর আদর্শ উদাহরণ। যে কর্মকান্ডের হদিশ পেয়েছি পরের তিনটে দিনে। একাধিকবার।

আড্ডার বিষয় স্থানীয় মানুষ এবং তাঁদের চেতনার বদল। এ প্রসঙ্গে এই আড্ডার সারমর্ম, পরিসংখ্যান সহ তুলে ধরলে বোধহয় এই বিস্তীর্ন এলাকাকে চিনতে আর বুঝতে সুবিধে হবে। গারোদের কথা খানিক বলেছি। এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতির কারনটা বলা যাক। আগেই বলা হয়ছে ১৮৬৫-র আগে এটি ছিল ভুটান রাজাদের অংশ। ব্রিটিশরা আসার পর স্থানীয় জমিদার বা করদ রাজাদের একটা অংশ ভুটানের প্রতি তাঁদের আনুগত্য বজায় রাখেন। তাই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়তে তাঁরা নিজস্ব সেনা বাহিনীও গঠন করেন। লড়াকু হিসেবে সুনাম ছিল গারোদের। তাই সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ানোর জন্য গারোদের আনা হয়। যেমন অভয়াপুরীর রাজাও আনিয়েছিলেন। তারপর তারাই নানান দিকে ছড়িয়ে গিয়ে অসমের এ অঞ্চলের বাসিন্দা হয়ে ওঠে।

এবার আসা যাক রাভাদের কথায়। সৌম্যদার কথা অনুযায়ী রাভারা আদতে পশ্চিম চিনের লোক। তখন অবশ্য চিন দেশ বলে কিছু তৈরি হয়নি। এমনকি চিনের লেখ্য ভাষার ছবিওয়ালা হরফও তৈরি হয়নি তখন। সে সময় ছিল সাং রাজবংশের শাসন। রাভাদের তারা মূলত দাস হিসেবে কাজে লাগাত। সেই অত্যাচার থেকে বাঁচতেই ওরা ক্রমশ পশ্চিম দিকে সরে আসতে শুরু করে। অধুনা মায়ানমার এবং ভারতের অরুণাচল, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড হয়ে তারা ধীরে ধীরে মেঘালয়, অসম এবং উত্তরবঙ্গেও প্রবেশ করে। শতকের পর শতক তারা এক সাংস্কৃতিক পরিবর্তেনর মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে, আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। ফলে ওদের নিজস্ব কোনো লেখ্য ভাষা নেই। কথ্য ভাষাতেও কালে কালে স্থানীয় ভাষা এবং অন্যান্য আদিবাসী জনজাতির ভাষা মিশতে শুরু করে। তার মধ্যেও এরা আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেদের সেই শিকড়কে খুঁজে পেতে, নিজেদের আহরিত সংস্কৃতির মধ্যে।

ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায়, সংখ্যার দিক থেকে সবথেকে বড় জনজাতির প্রসঙ্গে এবার আসতেই হবে। যারা অসমের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। বোড়ো। বোড়োদের আদি শিকড় নিয়ে সৌম্যদা, রাজদা ছাড়াও বহু ইতিহসবীদ ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। এমনকি বোড়োরা নিজেরাও। বোড়োদের একাংশের বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের শিকড় তিব্বত এবং ভুটানের গভীরে প্রথিত। কেউ কেউ মনে করেন অধুনা মায়ানমারের কোনো অংশ থেকে এদের আগমন। কিন্ত যুক্তি তর্ক এবং পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এরা এই অঞ্চলেরই বাসিন্দা। মহাভারতে যে কিরাত শ্রেণীর কথা উল্লিখিত আছে, আজকের বোড়োরা তাদেরই আধুনিক রূপ। কিরাত অর্থে সেই সমস্ত আধা যাযাবর মানুষ যাদের জীবন নির্বাহ কৃষি ভিত্তিক ছিল না। যারা প্রকৃতির উপর নির্ভর করত। যেমন জঙ্গলের ফলমূল, বিভিন্ন পশু পাখির মাংস যা শিকার করে পাওয়া যেত এবং নদীর মাছ। এদেরই একটা অংশের দীর্ঘদিনের বাস উত্তরবঙ্গ ও অসম-এর বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে। এমনকি সমতল লাগোয়া পূর্ব নেপালেও। নেপাল ভারত সীমান্তের মেচি নদী সংলগ্ন এই জনজাতিকে আমরা চিনি মেচ নামে। কারো কারো মতে এরাই আবার নেপালের ধুমল বা ধীমল। অসম অংশে এরাই পরিচিত বোড়ো নামে। আর একটি সূত্র বলছে অন্য কথা। যে ব্যাখ্যা বোড়োদের একটা অংশ মানে। বোড়োরা আসলে দিমাসা জনজাতি থেকে এসেছে। ভাষাগত ভাবে যারা টিবেটো-বার্মিজ ফ্যামিলির অন্তর্ভুক্ত।

মোট কথা একটা ব্যাপার নিশ্চিত বোড়োরা এই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা। সে অর্থে তাদের ভূমি-পুত্রও বলা যায়। স্বতন্ত্র আদিবাসী জনজাতির স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে বোড়োদের, ভারতীয় সংবিধানে। বোড়োদের কথা আলাদা করে বলার প্রধান কারন বিগত শতকের শেষ আড়াই দশকের অশান্ত অসম-এর মূল চিত্রটা বুঝে নেওয়া। না হলে যেমন এদের ভুল বোঝার অবকাশ থেকে যায়, তেমনই অসম বলতেই অনেকের মনে যে আতঙ্কের ছবি তৈরি হয় সেই ভ্রান্তিটাও কাটানো যায়। এখানে একটা ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। হয়তো অনেকেই একমত হবেন। একজন সাংবাদিক হিসেবে প্রায় কুড়ি বছর কাটিয়ে দিলেও মানস ন্যাশনাল পার্কের অস্তিত্বের খবর, মাত্র দশ বছর আগেও জানা ছিল না। মানস বলতেই বুঝেছি, মানস সরোবর। এমন কি অসম থেকে ফেরার পর শিলিগুড়িতে পাড়ার খবরের কাগজ বিক্রেতা দাদা দেখতে পেয়ে জানতে চেয়েছিলেন, কোথাও গিয়েছিলাম নাকি? মানস গিয়েছিলাম শুনে তাঁর তাত্‌ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, বাবা, সেখানে তো বেজায় ঠান্ডা। অর্থাত্‌ তিনিও ধরে নিলেন, আমি মানস সরোবর গিয়েছিলাম। নিজেকেই প্রশ্ন করি এর কারনটা কি? একটা কারন হয়তো জানতে চাওয়ার অনীহা। কিন্তু নিশ্চিতভাবে আরেকটি কারন বাংলার সংবাদ মাধ্যমে গোটা ভারতের তুলনায় উত্তর-পূর্ব ভারতের চোখে পড়ার মতন অনুপস্থিতি। বিশেষত অসম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম এবং অনেকটাই অরুণাচল। অনেক ভেবে একটা যুক্তিগ্রাহ্য কারন নিজের সামনেই খাড়া করা গিয়েছে। সেটি একেবারেই ব্যক্তিগত মতামত, তবু বলা যেতে পারে। অন্য মত পেলে সেটাও তো কম লাভের নয়।

ব্রিটিশদের সময় বাংলা সহ গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের কাজের ভাষা হিসেবে বাংলা-কে চাপিয়ে দেওয়ায়, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বাঙালিরাই অগ্রাধিকার পেয়ে এসেছে। অসম এবং মণিপুরের বাসিন্দারা বাংলা হরফকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। (সম্প্রতি মণিপুরি ভাষার নিজস্ব হরফ তৈরি হয়েছে। এখনও কাজ চলছে)। এই চিত্রটা স্বাধীনতার পরেও বদলায়নি। (তাই ক্ষোভ ছিলই। এবার অসমের মতন বৈচিত্রময় জনবসতির রাজ্যে, যখন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন তৈরি হল, তাতে এক অংশের এলিট ক্লাসেরও নীরব সমর্থন ছিল। তাই সেই আন্দোলন রাতারাতি বাঙালি খেদাও আন্দোলনে রূপান্তরিত হতে সময় নেয়নি। এর ফলে একদিকে যেমন দীর্ঘদিনের বসবাস ছেড়ে বহু বাঙালিকে অসম ছাড়তে হয়েছে, তেমনই প্রাণও গিয়েছে অনেক)। হয়তো এটা একটা কারন বাঙলা সংবাদমাধ্যমের অসম-এর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার।

১৯৭৯ তে আলফা (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ অসম) গঠিত হওয়ার পর শুধু বাঙালি বিরোধী আন্দোলনই নয়, একের পর এক বিচ্ছিন্নতাবাদী রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছে অসম। আমরা শুধু খবরে পড়েছি সেই আন্দোলনে হিংসার কথা অথবা সেনাবাহিনীর সাফল্যের কথা। ১৯৯০ এ সেনা সক্রিয় হওয়ার পর এবং বাঙলাদেশ সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আলফা নেতারা গ্রেফতার হওয়ার পর গতি হারায় আলফা-র আন্দোলন। ইতিমধ্যে পৃথক বোড়োল্যান্ডের দাবীতে ১৯৮৬-তে বোড়ো সিকিউরিটি ফোর্স শুরু করে বোড়ো আন্দোলন। প্রাথমিক ভাবে যার নেতৃত্বে ছিল অল বোড়ো স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা আবসু। এই সময়ে অসমে বাগানিয়া নামে পরিচিত হয়ে ওঠা, শতাধিক বছর ধরে বাস যে সব আদিবাসী জাতির, তাদের বিরুদ্ধেও শুরু হয় সক্রিয় আন্দোলন। মূলত সাঁওতাল, ওরাঁও, মুন্ডারা নিশানায় চলে আসে। অপরাধ? নতুন তৈরি চা-বাগানে কাজ করার জন্য ছোটানাগপুর অঞ্চল থেকে এদের নিয়ে এসেছিল ব্রিটিশরা। কোথাও লোভ দেখিয়ে, কোথাও গায়ের জোরে। তাই এরা অসমের মানুষ নয়। এদেরও তারাও। এরা ছাড়াও ২০০০ সালে নিশানায় আসে বাঙলাদেশী মুসলিম উদ্বাস্তুরা। মোদ্দা কথা এলাকার মানুষের বঞ্চনা। অসম থাকবে শুধু অসমের মানুষের। ১৯৯৩-এ আবসু-র নেতৃত্বে সরকারের সঙ্গে বিএসি (বোড়ো অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল) সংক্রান্ত চুক্তি সই হয়। কিন্তু সরকার ২৭৫০টি গ্রামকে এই কাউন্সিলের আওতায় আনতে অস্বীকৃত হয়। কারন এই গ্রামগুলিতে বোড়ো জনসংখ্যা গ্রামের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশেরও কম। এরই প্রতিবাদে স্বাধীন বোড়োল্যান্ডের দাবীতে আন্দোলন করা একটা গোষ্ঠী বেরিয়ে আসে। বাকিরা চুক্তি মেনে নেয়। যারা চুক্তি মেনে ছিল পরবর্তীতে তাদের ভূমিকা প্রসঙ্গে যথাসময়ে আলোচনা করা যাবে। বেরিয়ে যাওয়া অংশটা নিজেদের নতুন নামে পরিচিত করায়। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অফ বোড়োল্যান্ড বা এনডিএফবি। মূলত এদের নেতৃত্বেই শুরু হয় আদিবাসীদের উপর আক্রমণ। যার পাল্টা ১৯৯৬ এ তৈরি হয় আদিবাসী কোবরা ফোর্স। সামগ্রিকভাবে কিন্তু অসমের বিচ্ছিন্নতা আন্দোলন একটু একটু করে গতি হারাতে শুরু করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রথম যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল অসমের সমস্ত জনজাতিকে এক সাথে নিয়ে, পরবর্তীতে সেই আন্দলনই ক্রমে ক্রমে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী ভিত্তিক হয়ে দাঁড়ায়। এক সময়ের জঙ্গীরা মূলস্রোতে ফিরে আসতে শুরু করেন। এরপর ২০০৫ সালে সরকারের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই হয় এনডিএফবি-র। কিন্তু কায়েমী স্বার্থ সেটা মেনে না নিতে পারায় আবার একটা উপদল গঠিত হয়। যার নাম এনডিএফবি(এস)। মজার ব্যাপার এই দলের সর্বময় কর্তা নিজে কিন্তু বোড়ো জনজাতিভুক্ত নন। ইতিমধ্যে বিএসি থেকে রূপান্তরিত হয়ে গঠিত হয়েছে বিটিসি (বোড়ো টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল)। এরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই বোড়োল্যান্ডভুক্ত অঞ্চলের স্বায়ত্ব শাসন বজায় রেখেছে।

অস্থির অসমে কিন্তু ১৯৯৩ থেকেই শুরু হয়ে যায় গতি পরিবর্তনের কাজ। ২০০৩ এ এসে যা শুধু গতিই ফিরে পায়নি বিশ্বের দরবারে অসমবাসী তথা ভারতের মাথা উঁচুও করেছে। অথচ প্রতিবেশী রাজ্য হয়েও আমরা সে ব্যাপারে থেকেছি উদাসীন। বিস্তারিত ভাবে সে প্রসঙ্গে আসব মানস বায়োস্ফেয়ারে প্রবেশ করার সময়। মোট কথা এই প্রেক্ষিত-এ দাঁড়িয়েও কয়েকজন প্রচারবিমুখ মানুষ অক্লান্ত কাজ করে গিয়েছেন, এখনও যাচ্ছেন, রাজ্যের বিপুল বনসম্পদকে বাঁচানোর তাগিদে।

সোনালি বানরের দেশে

আজ সকাল সকাল বেরনো হল। চৌধুরিদাও আজ সঙ্গী। অনেকটা যেতে হবে। অনেক কিছু দেখতে হবে। বঙ্গাইগাঁওর সীমা ছাড়িয়ে যাব কোকরাঝাড় জেলায়। আজও সঙ্গী জাতীয় সড়ক ৩১। শেষে এক জায়াগায় জাতীয় সড়ক ছেড়ে গাড়ি বাঁক নিল ডানদিকে। খানিকটা যেতেই রাস্তার দু-ধারের শাল গাছের শামিয়ানায় রোদ হার মানলো। স্নিগ্ধ হল পরিবেশ। কিছুটা গিয়েই গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা ছোট্ট তে-মাথা। সামনে ডানদিকে পরিসর ঘাস জমি। খানিকটা বন্ধুর না হলে মাঠ বলা চলত অনায়াসেই। সেখানেই একতলা লম্বা একটা ঘর। দেখেই বোঝা যায় স্কুল। তখনই চোখে পড়ে সামনেই বোর্ড লাগানো। স্কুলের নাম ‘ধম্মা দীপা’। সেখান থেকেই উদ্ধার হয়, আমরা এখন কোকরাঝাড় জেলার ভাটিপাড়া অঞ্চলের বামনগাঁও-এ। রাজদার কাছেই জানলাম হালেই এই স্কুল শুরু হয়েছে। আর এটা রাজদার একটা স্বপ্ন-প্রকল্প। যাতে সর্বত ভাবে সাহায্য করছে বোড়ো টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল। আর প্রকল্প সহায়তায় আছে নর্থ-ইস্ট বুদ্ধিস্ট সংঘ কাউন্সিল। এমনকি স্কুলের উদ্বোধন করেছেন বিটিসি প্রধান মলিহারিজী  এবং সঙ্গে ছিলেন এই প্রকল্পে রাজদার প্রধান বন্ধু, দার্শনিক তথা পথপ্রদর্শক বিটিসি উপপ্রধান খাম্পা বরগোয়ারি। তবে স্থানীয় ভাবে সমস্ত কিছু দেখভালের দায়িত্বে আছেন বিশিরাম নার্জারি।

এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে মাথায় রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ এই অঞ্চলটাকে পর্যটন হাব হিসেবে গড়ে তোলা। তার আর একটা কারন এখান থেকে খুব কাছেই চক্রশিলা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি। যেহেতু এলাকার আদিবাসী জনজাতিদের একাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী তাই এখানে একটি বৌদ্ধ মন্দির এবং তারা মন্দির গড়ে তোলার পরিকল্পনাও আছে। স্কুল দেখা শেষ করে পায়ে হেঁটেই জঙ্গলের ধার ঘেঁষে পদচারনা। খানিক এগোতেই নয়নাভিরাম দৃশ্য। দুদিকে জলাভূমির দীর্ঘ বিস্তার। যার শেষে দুদিকেই সবুজে মোড়া পাহাড় অতন্দ্র প্রহরায়। ইসসস, এখানে যদি একটা রিসর্ট থাকত। রাজদা শুনে খালি হাসল। কোনো মন্তব্য করল না। সুনিলজী মনের মতন বিষয় পেয়ে শুধু শাটার ধ্বনিতে ভরিয়ে দিয়েছেন আবহ।

চক্রশিলা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি। গোল্ডেন লাঙ্গুর বা সোনালি বানরের আঁতুর ঘর। গোল্ডেন লাঙ্গুরের জন্য ভারতের প্রথম তথা একমাত্র সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ১৯৯৪ এ স্যাংচুয়রির তকমা পায়। ভারতীয় বন্যপ্রাণ আইনে সিডিউল ওয়ান তালিকাভুক্ত প্রাণী গোল্ডেন লাঙ্গুর। জঙ্গলে প্রবেশের খানিক আগেই শালের ঘন বন দেখে মন উচ্ছসিত। যা দেখে সৌম্যদার মৃদু হাসি। জানা গেল, এটা জঙ্গলের অংশই নয়। একটা সময় বেআইনি দখলদাররা এসে নির্বিচারে বসবাস শুরু করে এখানে। গাছ কাটার পিছনে যেমন ওদের হাত ছিল তেমনই জঙ্গল ধ্বংসের আর একটা কারন অসমের জঙ্গী আন্দোলন। গত পঁচিশ বছর ধরে সৌম্যদার নেতৃত্বে তাঁর সংগঠন নেচার্স বেকন সাধারন মানুষের মধ্যে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তারই ফল, দখলদার হটিয়ে নতুন করে গাছ লাগানো। জঙ্গলকে কেন্দ্র করে যে ছত্রিশটি গ্রাম আছে তাদের সার্বিক জীবনধারার মানোন্নয়ন ছাড়াও প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং স্কুল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে নেচার্স বেকন। আজ এই অঞ্চলের রাভা, গারো, রাজবংশী, বোড়ো এবং মুসলিম অধিবাসীরা সর্বোত ভাবে সংরক্ষণের কাজে যুক্ত। তবে এদের দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের পথ আরও সুগম করতে এবার এখানে চালু হচ্ছে হোম-স্টে ট্যুরিজম। যা এবছরের(২০১৬) পুজোর আগেই শুরু হয়ে যাবে। আর কেন্দ্রে অবশ্যই গোল্ডেন লাঙ্গুর।

ধুবরি জেলা লাগোয়া এই বনাঞ্চল ৪৫ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত। মূলত টিলা পাহাড়ের গায়ের জঙ্গলই এর আওতায়। পাহাড়ের উপর দিকের উল্লখযোগ্য গাছ হল ত্রিফলা। অর্থাত্‌ আমলকি, হরিতকি আর বয়রা গাছ মেলে বিস্তর। শেষ সুমারি অনুযায়ী গোল্ডেন লাঙ্গুরের সংখ্যা ৮০০-র কিছু বেশি। এখানে ৩৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেখা মেলে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য লেপার্ড, লেপার্ড ক্যাট, জাঙ্গল ক্যাট, ফিশিং ক্যাট, বিগ ক্যাট (রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার)। এই মুহুর্তে সংখ্যায় তারা ৬। আর আছে ক্র্যাব ইটিং মঙ্গুজ, উদ্বিড়াল, মালায়ান জায়েন্ট স্কুইরেল, উড়ুক্কু কাঠবেড়ালি, প্যাঙ্গোলিন, বার্কিং ডিয়ার, সম্বর, গাউর, বুনো শুয়োর প্রভৃতি।

বনাঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে ধীর এবং দীপলাই বিল। যেখানে শীতকালে ২৮২ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। এর মধ্যে ধীর বিলটি চন্দ্রডিঙা পাহাড়ের পাশ দিয়ে মিশেছে ব্রহ্মপুত্রর সঙ্গে। চৌধুরিদা জানালেন আগ্রহী পর্যটকদের জন্য ব্রহ্মপুত্রে শুশুক দর্শনের ব্যবস্থাও আছে।

আমরা একটি রাভা বাড়িতে ঢুকলাম। গ্রামের গাঁওবুড়ার বাড়ি। প্রবেশের সাথে সাথে বৃদ্ধা ঘরনীর অনুযোগ সৌম্যদার উদ্দেশে, উনি নাকি এঁদের ভুলেই গিয়েছেন, তাই অনেকদিন বাদে এলেন। নিমেষে আমাদেরও আত্মীয়তার বন্ধনে জড়িয়ে নিলেন। দেখা গেল হোম স্টে-র ব্যবস্থা হচ্ছে এই বাড়িতেও। রীতি অনুযায়ী আপ্যায়িত হলাম পান-তাম্বুলে। কেউ নিলেন কেউ নিলেন না। গৃহিনী জানতে চাইলেন লাউপানি চলবে কিনা! লাউপানি? বোধহয় মুখের ভূগোল দেখেই রাজদা এগিয়ে এলো উদ্ধার করতে। লাউপানি-ও আসলে এক ধরনের রাইস বিয়ার। রাভা-দের নিজস্ব ঘরানার পানীয়। আসলে এরা কুম্ভকার হিসেবে কোনোদিন-ই দড় নয়, তাই প্রাচীন পদ্ধতিতে শুকনো লাউ-এর খোলে ফার্মেন্টেশন করা হত এই দেশীয় পানীয়ের। সেখান থেকেই নামকরন, লাউপানি। কিন্তু এই গরমে? গাঁওবুড়া জানালেন শরীর ঠান্ডা হয়। রাজদার বিনীত নিবেদন, প্রতিবেদক এবং চৌধুরিদা বাদে বাকিরা ও রসে বঞ্চিত। তাই সই। দুজনের জন্যই এলো। গরমের দুপুরে আপ্যায়িত হলাম। শরীর ঠান্ডা হল কিনা, সে প্রশ্ন অবান্তর।

কোকরাঝাড় পৌঁছে মধ্যহ্ণ ভোজন সারা হল। বিকেল চারটের সময় খাওয়াকে মধ্যাহ্ণ ভোজন বলা যাবে কিনা সেটা একটা প্রশ্ন। সেখানেই ভারি অদ্ভুত্‌ এক বিলবোর্ড চোখে পড়ল। যার সার মর্ম, “আমাদের সঙ্গে চলুন যমদুয়ার, উষ্ণ আতিথেয়তায় উপভোগ করুন প্রকৃতি।” মানেটা কি! যমের দোরে বেড়াতে যাওয়া! আমাকে হাসতে দেখে বাকিরা কিন্তু হাসল না। রাজদা বরং পরম যত্নে আমার সংশয় দূর করল। যমদুয়ার অসম ভুটান সীমান্তের আটটি দুয়ারের একটি। তবে যম দুয়ার নামকরন হয়েছে স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে। তার একটি সম্ভাব্য কারন হল, এক সময় ওই অঞ্চল থেকে আদিবাসী রমণিদের তুলে নিয়ে যাওয়া হত ভুটানে। যাদের আর খোঁজ পাওয়া যেত না কোনোদিন। অর্থাত্‌ যমের বাড়ি গেলে যেমন কেউ ফেরে না, তেমনি কোনো মহিলা ওই অঞ্চলে গেলে আর ফিরতেন না। তাই এই নাম। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নাকি অসাধারন। তাই এখন পর্যটন গন্তব্য হয়ে উঠেছে এক সময়ের কুখ্যাত যমদুয়ার। আমাদের হাতে সময় নেই তাই এ যাত্রায় যাওয়া হল না।

পরের গন্তব্য, উল্টাপানি। মানস বায়োস্ফিয়ারের মধ্যে দিয়ে ২৩ কিলোমিটার গিয়ে ভুটান সীমান্তের ১০ কিলোমিটার আগে এই গ্রাম। যার তিনদিক-ই জঙ্গলে ঘেরা। আরও একটি দুয়ার। ভুটানের সারভাং সীমান্ত। তবে আগে মানস নিয়ে কয়েকটি তথ্য দেওয়া যাক। মানস। স্থানীয় উচ্চারনে মানখ্‌। ১৯০৭ সালে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষিত হয়। ১৯২৮ সালে ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি। এরপর ১৯৮৫ তে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট, ১৯৮৯-এ বায়োস্ফিয়ার আর তার পরের বছরেই জাতীয় উদ্যান। বায়োস্ফিয়ার অঞ্চলটি ২৮৩৭ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত। তার মধ্যে জাতীয় উদ্যানের অংশ ৫২৬ দশমিক দুই দুই বর্গ কিলোমিটার! শুধু তাই নয় একাধারে মানস যেমন একটি টাইগার রিসার্ভ, তেমনই এরই একটি বিস্তীর্ন অঞ্চল চিহ্নিত চিরাং-রিপু এলিফ্যান্ট রিসার্ভ হিসেবে। অসমের ৬ টি জেলা জুড়ে বিস্তৃত এই বিশাল বনাঞ্চল। জঙ্গলের মধ্যে একটি মাত্র গ্রাম, আগরঙ্গ। তবে জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের সংখ্যা অনেক। বাপরে! তথ্য শুনে মনে হল উত্তরবঙ্গের জলদাপাড়া বা গরুমারা জাতীয় উদ্যান যেন বাড়ির পিছনের আগাছার জঙ্গল। তখনও জানা নেই আরও কত চমক অপেক্ষা করে আছে!

জাতীয় সড়ক ৩১ সি পার করে গাড়ি ঢুকলো উল্টাপানির রাস্তায়। ১২ কিলোমিটার যাওয়ার পরেই এসএসবি পথ আটকালো। পরিচয়পত্র দেখিয়ে তবে মিলল জঙ্গলে প্রবেশের অনুমতি। শুরু হল দুপাশে ঘন জঙ্গল। সৌম্যদা জানালেন জঙ্গল যতই ঘন হোক এটা কোর এরিয়া নয়। হঠাত্‌ সারথি রবিন গাড়ি দাঁড় করাল। যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। রাস্তার ধারের গাছে এক পাল গোল্ডেন লাঙ্গুর। বলতে ভুলেছি সকালে চক্রশিলাতে প্রথম দর্শন মিলেছিল গোল্ডেন লাঙ্গুরের। তবে সংখ্যায় ছিল মাত্র দুটি। এখানে ধেড়ে কচি মিলে প্রায় গোটা কুড়ি। তার সঙ্গেই বন্য কাঠবিড়ালি। জঙ্গল প্রবেশের সাথে সাথেই যেন উষ্ণ আপ্যায়ন। তারপর ২৩ কিলোমিটার ধরে শুধুই জঙ্গল। পুরো পথে আরও দুটি দৃশ্য চোখে পড়ল। একটি উত্‌সাহবর্ধক অন্যটি হৃদয় বিদারক। পথের একটা বড় অংশ জুড়ে হাতির পটি। দুদিন থেকে এক সপ্তাহের পুরনো। অর্থাত কপালে থাকলে দেখা মিলতে পারে। যে জঙ্গলে হাতির সংখ্যা ৬৫৮-রও বেশি (২০০৩ হস্তি সুমারি), সেখানে সম্ভাবনাটা প্রবলই বলা যায়। ফেরার সময় রাতের অন্ধকারে সে সম্ভাবনা তৈরিও হয়েছিল। টাটকা পটি সে ইঙ্গত দিয়েছিল, কিন্তু কপাল খারাপ সেনাবাহিনীর গাড়ি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আমাদের টপকে আগে গিয়ে সে সম্ভাবনায় জল ঢেলে দিয়েছিল। সেনাবাহিনীর বোধহয় জঙ্গলে গতি সীমা মানার প্রয়োজন হয় না!

দ্বিতীয় দৃশ্যটা হল সাইকেলে করে কাঠ নিয়ে যাওয়া। এমনিতে দৃশ্যটায় অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু কাঠের পরিমান আর তার কোয়ালিটি এটুকু ইঙ্গিত দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল যে এ কাষ্ঠ আহরণ সম্পূর্ণ আইনি নয়।

উল্টাপানি বাজারে ঢোকার আগে আর এক প্রস্থ চেকিং। এবার সেনাবাহিনী। উল্টাপানি বাজারে পৌঁছতেই দেখা হয়ে গেল ব্রহ্মাদার সঙ্গে। প্রবীন এই মানুষটি কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে বন আর বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের কাজ করে যাচ্ছেন। রাজদা-কে দেখে বেজায় খুশি। সঙ্গে অনুযোগ এত দিন বাদে আসার জন্য। বাজারে চা খেয়ে গেলাম গ্রামের মধ্যে গিরীন ভাইয়ের বাড়িতে। চৌধুরিদার সহায়তায় এখানে হোম স্টে-র ব্যবস্থা হয়েছে। আলাপ হল বৃদ্ধ মঙ্গল সিং গুরুং আর কনক নার্জারির সঙ্গেও। এরা সকলেই সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত প্রাণ। হ্যাঁ, এ গ্রামেও মানুষ বন্যপ্রাণের বিরোধিতায় হঠকারী। তবে এঁদের উদ্যোগে গ্রামের মানুষ এখন অনেক বেশী সচেতন। সহসা বন্যপ্রাণ হত্যা করার কথা আর ভাবেন না।

বাড়ির সামনে মুক্ত দাওয়ায় চেয়ার নিয়ে বসলাম। জমে উঠল জঙ্গল বিষয়ক আড্ডা। সামনে মেঘ মাখা বিষন্ন হিমালয়। বাম থেকে ডান যতদূর চোখ যায়। সুর্যও সদ্য মুখ লুকিয়েছে ভুটান সীমান্তের আড়ালে। বাদল মেঘে কোথাও কমলা কোথাও বা বেগুনি রঙের আঁকিবুকি। পাহাড়ের কোল ঘেঁষা দুই সহদরা মানস বায়োস্ফিয়ার আর রয়্যাল মানস-এর গাছেরাও যেন আসন্ন রাতের প্রস্তুতিতে গম্ভীর। পাখিদের ঘরে ফেরার ব্যস্ততা। তার মাঝেই গাছের মাথায় একা এক হর্নবিলের বিলাপ ধ্বনি। এক অন্যরকম ভাল লাগায় ভরে উঠল হৃদয়। মুছে গেল সকাল থেকে ছুটে চলার সমস্ত ক্লান্তি।

মাওজিগেন্দ্রি

কাল গিয়েছিলাম মানসের পশ্চিমতম প্রান্তে। আজ যাত্রা পূর্বতম দিকে। মানস জাতীয় উদ্যানের তিনটি রেঞ্জ। পানবাড়ি, বাঁশবাড়ি আর ভুঁইয়াপাড়া। আমরা এখন তৃতীয় রেঞ্জ সংলগ্ন লখখিবাজার এলাকায়। এখান থেকে ভুটান সীমান্ত নামলাং মাত্র ৮ কিলোমিটার। আলাপ হল চন্দ্রকান্ত বৌমাতারির সঙ্গে। তার বাড়ি ঘুরে এসে বসলাম আবসুর অফিস কাম মেস-এ। রাজদা জানালো এই অফিস অনেকগুলি কারন গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের সঙ্গে চুক্তির আগে এই অফিসই ছিল জঙ্গী কার্যকলাপের অন্যতম ঠিকানা। পরে ইউনেস্কো এবং ডাব্লিউ ডাব্লিউ এফ-এর প্রতিনিধিরা এখানে এসে বৈঠক করে গিয়েছেন। এমনকি সংরক্ষণ আন্দোলনকে গড়ে তোলার সময় এই মেসেই রাতের পর রাত কেটেছে রাজদার। আমরা এখন তিনজন। চৌধুরিদা বা সৌম্যদা এই পর্যায়ে নেই।

আলাপ হল বিরখাং বরগোয়ারির সঙ্গেও। পর্যটন প্রসারের নেতৃত্বে ইনি কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরেই। চন্দ্রকান্ত নিজেও একসময়ে সশস্ত্র আন্দোলনে সামিল ছিল। তবে আজ সে সম্পূর্ণ ভাবে সংরক্ষণ কর্মী। শুধু সে নয়, বোড়ো আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত একটা বড় অংশ আজ বুঝেছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই প্রয়োজন বন এবং বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ। রাজদার মতন বঙ্গাইগাঁও-এর দে-দারাও এদের মনভাব পরিবর্তনে ২৫ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। যার ফলস্বরূপ মাওজিগেন্দ্রি ইকো ট্যুরিজম সোসাইটির জন্ম। যাদের সহায়তায় ৮০ জন জঙ্গী পরবর্তীতে সংরক্ষণ আন্দোলনে স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকায় অবতীর্ন হয়। যাদের মধ্যে ৪০ জনের মাসোহারার ব্যবস্থা করেন বিটিসি-র উপপ্রধান খাম্পা সাহেব। এখন স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা ৩৩ জন। নিয়মিত মাসোহারা পায় তারা। জঙ্গী আন্দোলনের পথ ছাড়লেও এরা অস্ত্র ত্যাগ করেনি। একসময়ের মানুষ মারা যন্ত্র আজ এরা ব্যবহার করে জঙ্গলকে রক্ষা করতে। মানস এর কোর অঞ্চলের প্রায় দুশো বর্গকিলোমিটার এলাকা এরাই পাহারা দেয়। সরকার কিছু কর্মী দিলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। তাই বিতর্ক থাকলেও এদের উপস্থিতি মেনে নিয়েছে সরকার। হাতে হাতে ফলও মিলেছে। একটা পরিসংখ্যান দিলেই পরিস্কার হবে বিষয়টা।

যে বছর আলফার জন্ম, সে বছর মানসে বাঘের সংখ্যা ছিল ৬৯টি। পরবর্তী ৫ বছরে যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২৩টিতে। এরপর জঙ্গী আন্দোলন বাড়তে থাকে। জন্ম হয় বোড়ো আন্দোলনের। ১৯৮৯-এ তার প্রভাব চোখে পড়ে বাঘের সংখ্যায়। কমে দাঁড়ায় ৯২-এ। ৪ বছর পর যে সংখ্যাটা আরও কমে ৮১তে নেমে আসে। যথেচ্ছ গাছ কাটা আর চোরা শিকারের রমরমা তখন গোটা মানস জুড়ে। বাধ্য হয়ে ইউনেস্কো মানসকে বিপজ্জনক অবস্থায় থাকা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট-এর তালিকাভুক্ত করে। সেই ১৯৯৩-এ সরকার বিএসি-র দাবী মেনে নেয়। বোড়োদের একটা বড় অংশ জঙ্গী আন্দোলন থেকে সরে আসে। তখনই শুরু হয় নতুন আন্দোলন। সংরক্ষণ আন্দোলন। ফলও মেলে হাতেনাতে। ৯৫-এ বাঘের সংখ্যা বেড়ে হয় ৯৪টি, ২০০১-এ ৯৮টিতে পৌঁছয়। ২০০৩ এ প্রতিষ্ঠিত হয় মাওজিগেন্দ্রি সোসাইটি। বোড়োদের ভূমিকার এই পরিবর্তনে অবশেষে ইউনেস্কো-ও স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ২০১১-এ বিপজ্জনক তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় মানসকে। অসম-এর সংরক্ষণ আন্দোলন আজ রূপান্তরিত একটি দর্শনে। যা নতুন করে প্রাণ দিয়েছে এই অঞ্চলের ডুয়ার্সকে। হ্যাঁ, এখনও এনডিএফবি(এস) নামধারী একটি গোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন জঙ্গী কার্যকলাপ চালাচ্ছে, কিন্তু বোড়োদের একটা বড় অংশ তাদের বিরুদ্ধে।

গেলাম মাওজিগেন্দ্রি সোসাইটি পরিচালিত ট্যুরিস্ট লজ দেখতে। জঙ্গলের কোল ঘেঁষে এর অবস্থান। জানা গেল মাওজি মানে বিড়াল আর গেন্দ্রি মানে পেট মোটা বা অন্তসত্তা। ফার্টিলিটি বোঝাতেই সোসাইটির এই নাম। সম্ভবত গন্ডারের পেটমোটা গড়নের জন্যই তাকে গেন্দ্রি বা গেন্দি বলা হয়। গন্ডার শব্দটার সঙ্গেও এই মানে যুক্ত থাকলে অবাক হব না। এরপর ঢুকলাম জঙ্গলে। হেওয়ালি ফরেস্ট ক্যাম্প। এমইটিসি, বিটিসি আর বনদফতর যৌথ উদ্যোগে জঙ্গল পাহারার জন্য এই ক্যাম্পটি রাখা হয়েছে। জঙ্গলের এই অংশের গাছপালার প্রকৃতিতে বেশ অবাক হলাম। উল্টাপানির উল্টো একদম। সেখানে ছিল বড় গাছের আধিক্য আর এখানে ঝোপঝাড় বেশি। রাজদা জানাল রেন ফরেস্ট না হলেও উল্টাপানি অঞ্চলে রেন ফরেস্টের প্রায় সব প্রজাতির গাছ পাওয়া যায়। গাছের পরিসংখ্যান দেখে তো চোখ কপালে। মোট ৪৫৯ ধরনের গাছ পাওয়া যায় এই জঙ্গলে! যার মধ্যে ৮৯ ধরনের বৃক্ষ, ৪৯ ধরনের বড় ঝোপ, ৩৭ রকমের ছোটো ঝোপ, ১৭২ প্রকারের ভেষজ, ৩৬ প্রজাতির লতানে গাছ, ১৫ রকমের অর্কিড, ১৮ রকমের ফার্ন আর ৪৩ প্রকারের ঘাস পাওয়া যায় মানস বায়োস্ফিয়ারে! বাপরে বাপ!

জঙ্গলেই সন্ধে নামে। চন্দ্রকান্ত, বিরখাং-দা আর জঙ্গল ক্যাম্পের রক্ষীদের থেকে বিদায় নিয়ে আবার শুরু হল আমাদের চলা। এবার গন্তব্য মানসের মধ্য রেঞ্জ বাঁশবাড়ির উদ্দেশে। সাধারনত পর্যটকরা মানস বলতে এই অংশটাতেই আসেন এবং এই বিশাল জঙ্গলের মাত্র ১৬ কিলোমিটার ঘুরে দেখেই চলে যান। রাতের অন্ধকারে জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামগুলির মধ্যে দিয়েই চলল গাড়ি। প্রায়  রাত নাট নাগাদ পৌঁছলাম গন্তব্যে। চা বাগানের মধ্যেই বিরিনা ট্যুরিস্ট লজ। কোনো কালে অফিসার্স বাঙলো ছিল। বোড়ো আন্দোলনের জেরে যখন চা বাগান পরিত্যক্ত হয়ে যায় তখন চৌধুরিদা লিজে নিয়ে তাকে দিব্যি রিসর্টে পরিণত করেছেন। এখন অবশ্য রিসর্ট সহ চা বাগনও চালু। এটাই আপাতত আমাদের দু রাতের ঠিকানা।

 

আকৌ আহিম

ভোরে বৃষ্টির আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। বাইরে এসে বসলাম। বৃষ্টির তেজ এখন কম। বাগানে কাজে যাচ্ছে নারী পুরুষ নির্বিশেষে বাগানিয়ার দল। এরা এখন আর কেউ আলাদা ভাবে সাঁওতাল, ওঁরাও বা মুন্ডা নয়। এরা আজ অসম দেশের বাগানিয়া। এখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে দিব্যি মিশে গিয়েছে। তাই ‘ছাতা ধর হে দেওড়া…’, আজ অনায়াসেই অসমিয়া ঝুমুর-এর স্বীকৃতি পায়। আবার এক সময় এদের স্বপ্ন ‘চল মিনি আসাম যাবি…’ যখন স্বপ্ন ভঙ্গের গাথায় পরিণত হয় ‘… বাবু বলে কাম কাম, সাহেব বলে ধরি আন, সর্দার বলে লিব পিঠের চাম, ও যদুরাম, ফাঁকি দিয়া পঠাইলি আসাম…’, সেই গানও অনায়াসে শোভা পায় অসমিয়া লোকশিল্পির কন্ঠে।

জলখাবার খেয়ে ঠিক হল আজ পায়ে হেঁটেই বের হব। দুপুরেও কোনো গ্রামে যা পাওয়া যায় তাই খাওয়া হবে। বনে এসে একটু বন্য হওয়া। এই অঞ্চলটা অসমের বকসা বা বাকসা জেলায় পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্সেও বকসা নামের টাইগার রিসার্ভ আর জায়গা আছে। কিন্তু এত কাছাকাছি একই নামের দুটো জায়গার কারন কি? আবার ত্রাতার ভুমিকায় রাজদা।

একটা মত বলে এই দু জায়গাতেই ব্রিটিশরা সম্ভবত চায়ের পেটি রাখার গুদাম বানিয়েছিল। সেই বাক্স থেকে বক্সা। তবে অন্য ব্যাখ্যাটা বেশি যুক্তিগ্রাহ্য। স্থানীয় ভাষায় সা মানে আছে। আর বাক হল বাঘ-এর অপভ্রংশ। বাঘ সা অর্থাত এখানে বাঘ আছে। সেই বাঘ সা-ই কালে দিনে বাকসা বা বকসা হয়ে গিয়েছে।

চা বাগান ধরে হেঁটে আমরা পৌঁছলাম একেবারে অরণ্যের ধারে। রাজদা সতর্ক করে দিল। যেন চোখ কান খুলে চলি। বলা যায় না, কারো দর্শন মিলতে পারে। জঙ্গলকে ডানদিকে নিয়ে খানিক দূর যাওয়ার পর পাশাপাশি তিনটে রিসর্ট পড়ল বাঁদিকে। তার শেষের রিসর্টটায় ঢুকলাম। মানসের অন্যতম বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি ফ্লোরিকান-এর নামে রিসর্টের নাম। ফ্লোরিকান কটেজ। যেটি চালায় মিউজ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। মিউজ অর্থাত্‌ মানস এভার ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। আলাপ হল বর্মন ভাই, টুটু ভাইদের সঙ্গে। রাজদা শুধু পূর্ব পরিচিতই নয় বহুবার ঘুরে গিয়েছে। এরাও সংরক্ষণের কাজই করে। তবে এরা মিক্সড কমিউনিটি। রাভা, বোড়ো, রাজবংশী, নেপালি বিভিন্ন প্রজাতির মানুষ মিলে একসঙ্গে আন্দোলনটা চালাচ্ছে। ২০০৩ সাল থেকে এরা রেজিস্টার্ড। সংরক্ষণ আন্দোলনকে চালিয়ে নিয়ে যেতেই পর্যটনের ব্যবসা শুরু। ২৪ জনের এক্সিকিউটিভ কমিটি আজ কমে ৯ জনে এসে দাঁড়ালেও এদের কর্মকান্ড কিন্তু সফল। শুধু এই রিসর্টের বার্ষিক টার্ন ওভার ৩৫ লাখ টাকা ছুঁয়েছে! রিসর্টের জমি সহ মালিকানা অংশিদারী ভিত্তিতে সদস্যদের মধ্যে আইনি ভাবে বন্টিত! পর্যটনের বাইরে গ্রামের মানুষের উন্নতির জন্য কাজ করছে এরা। সোলার লাইট লাগানো, ছোটোদের স্কুলমুখি করা, বেকারদের জঙ্গল সাফারির কাজে এগিয়ে আসতে উত্‌সাহ দেওয়া প্রভৃতি একগুচ্ছ কর্মকান্ড! টুটু ভাই-এর উপর পর্যটনের পুরো দায়িত্ব। ঋষিকেশ থেকে রিভার rafting-এ প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে। পর্যটকদের raft-এ করে মানস নদীতে সাইট সিইং-এ নিয়ে যায়। যে নদীর দুপাশে ঘন জঙ্গল। মানসের কোর এরিয়া।

খানিক আড্ডা মেরে, চা খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। জঙ্গলের পাশ দিয়ে হাঁটতে বেশ লাগছিল। তার মধ্যে মেঘলা আকাশ আর হাওয়ার জন্য কষ্টও ছিল না বিশেষ। মানসে প্রায় ৬০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে! গোটা দেশের কোনো জঙ্গলে যা নেই! এর মধ্যে ২২টি প্রজাতি বিলুপ্তপ্রায় শ্রেণীর। একমাত্র এখানেই পাওয়া যায় গোটা ভারতের সব থেকে বিশুদ্ধ প্রজাতির বন্য মহিষ। এছাড়াও আছে ৪২ প্রজাতির সরীসৃপ, ৭ প্রকারের উভচর এবং ৫০০ প্রজাতির পাখি! যার মধ্যে বিশ্বজুড়ে বিলুপ্তপ্রায় ২৬ প্রজাতির পাখিও সামিল। মনে মনে ভাবি ইশ্‌শ্‌ তখন যদি ইউনেস্কোর প্রস্তাব মেনে নিত আমাদের রাজ্য সরকার তাহলে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্স, অসমের ডুয়ার্স আর ভুটানের জঙ্গল মিলে এক সুবিশাল অরণ্য থাকতো বিশ্বের এই অঞ্চলে। আশির দশকে ইউনেস্কো প্রস্তাব দেয় জলদাপাড়া, গরুমারা সহ উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চল সংলগ্ন গ্রামগুলিকে সরিয়ে তাদের পুনর্বাসনের। যাতে একটি অবিচ্ছিন্ন ফরেস্ট করিডোর তৈরি হয়। কিন্তু যে কোনো কারনেই হোক তত্‌কালীন রাজ্য সরকার এ প্রস্তাব মানেনি!

হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছলাম নদীর ধারে। সম্প্রতি এই নদীই ভাসিয়েছে জঙ্গল আর লোকালয়। জল কমলেও নদী যেন ফুঁসছে এখনও। বেকি-মানস। উত্তর দিকে তাকালেই দেখা যাচ্ছে বেকি আর মানস নদীর সঙ্গমস্থল। মিলনের পর সে যেন আরও রুদ্র। সাম্প্রতিক বন্যার সময় এই নদীই জঙ্গলের খানিকটা খেয়ে নিয়েছে। যার চিহ্ন আমাদের সামনেই। নদীর রূপ দেখে বিস্ফারিত চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসার জোগাড় হল যখন দেখলাম ৮ থেকে ১০ বছরের দুটি বাচ্চা হঠাত্‌ জামা কাপড় খুলে উদোম হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীর বুকে। তারপর স্রোতের বিপরীতে কুশলি হাতের স্ট্রোকে এগিয়ে যাওয়া। এদের সঠিক পরিকাঠামোয় প্রশিক্ষণ দিলে কি এক আধটা মাইকেল ফেল্পস তৈরি হয় না! কে জানে? হঠাত্‌ চোখ গেল শুধু এ দুজনই নয়, নদীর চর থেকে দুটি ভিন্ন ভিন্ন নৌকাও ধেয়ে আসছে মাঝ বরাবর। রহস্য পরিষ্কার হয় এবার, প্রবল স্রোতে ভেসে আসছে ভাঙনে উপড়ে পড়া এক আস্ত গামার গাছ। প্রতিযোগিতা তারই দখল নেওয়ার। যে আগে ছোঁবে গাছ তার। পরে সেই গাছ বেচেই পয়সা। চোখের সামনে এক অন্য আন্দোলনে আন্দোলিত হল মন।

নদীর পাড়ে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে গিয়ে উঠলাম বেকির রোষ থেকে এক চুলের জন্যে বেঁচে যাওয়া ওয়াচ টাওয়ারে। বাঁদিকে বেকি-মানস। সামনে আর ডাইনে মানস জাতীয় উদ্যান। পিছনে গ্রাম। আর সামনে খানিক দূরে উদ্ধত হিমালয়। ভুটান। লৌকিক দেবী মনসার নাম থেকেই নদীর নাম মানস। জঙ্গলের বুক চিরে বয়ে চলা মানস নদীর নাম থেকেই মানস জাতীয় উদ্যান। কেন দেবী মনসা? না, উত্তর দিতে পারলে কোনো পুরষ্কারের ব্যবস্থা নেই।

প্রকৃতিতে এতটাই বুঁদ হয়ে ছিলাম যে রাজদা ডাকছে খেয়ালই করিনি। তারপর রাজদার হাতের ইশারা লক্ষ্য করতেই শিহরিত! নিচে একটু দূরেই সবুজে ছাওয়া জলাশয়ে একটা পূর্ণ বয়স্ক রাইনো।

মনে হতেই পারে যেখানে কাজিরাঙা, জলদাপাড়া বা গরুমারায় গেলেই হুদো হুদো রাইনো দেখা যায় সেখানে একটা রাইনো দেখেই এত উচ্ছাসের কারন কি? বিশেষত তিনজনের কেউই এই প্রথম গন্ডার দেখছি না! উচ্ছসিত হওয়ার কারন আছে বৈকি। আঠাশ’শ বর্গমাইল জঙ্গলে গন্ডারের সংখ্যা যে মাত্র ২২টি! তাও ২০০৮ এ পবিতোরা জাতীয় উদ্যান থেকে ১০টি এবং ২০১২-এ কাজিরাঙা থেকে ৪টি গন্ডার এখানে ছাড়ার পর এই সংখ্যা! অশান্ত সময়ে মানসের গন্ডার সবথেকে বেশি দুর্ভাগ্যের শিকার। চোরা শিকারীদের প্রধান টার্গেট হয়ে ওঠে ওরা। এক তো খড়গের লোভে। তার সঙ্গে আছে গন্ডারের মাংস খাওয়ার উত্‌সাহ। কারনটা একই। পৌরুষ বৃদ্ধির অন্ধ বিশ্বাস!

গন্ডারের জলকেলি দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে যায়। এবার ফেরার পালা। কাল সকালেই শিলিগুড়ি প্রত্যাবর্তন। প্রথমবারেই প্রেমে পড়েছি মানসের। তাই ছেড়ে যেতে মন চায় না। তবুও ঘরে যে ফিরতেই হবে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে নামবার আগে তাই মানসের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে অঙ্গীকার করি, ‘আকৌ আহিম, মানখ্‌, আকৌ আহিম’ (আবার আসবো, মানস, আবার আসবো)।

চড়

গোপালকে সকাল সকাল আসতে বলেছিলেন মহামায়া। ব্যাঙ্ক খোলার সঙ্গে সঙ্গেই কাজটা সারতে চান। না হলে বড্ড দেরী হয়ে যায়। শরীর একদম দিচ্ছে না আজকাল। হাঁটাতো প্রায় বন্ধ। কোনোক্রমে ঘষটে ঘষটে বাথরুম পায়খানা। রান্নার মেয়েটাই সকালে সব করে দিয়ে যায়। ইদানিং বড্ড মুখ বেড়েছে ছেমরির। গত মাস থাকতেই বলে দিয়েছে আজই নাকি তার টাকা চাই। না হলে অন্য লোক দেখে নিতে। অবশ্য তার জন্য বোধহয় মাহামায়া নিজেই দায়ী। বেশ ডাগোর ডোগোর হয়েছে মিনু। ছোটোবেলা মায়ের আঁচলের আড়ালে আসতো। এখন ষোলো। এখন শাড়ি। কাজ বলতে এই এক বাড়ি। মূলত রান্না, টুকিটাকি ফাইফরমাশও ছিল। ঝাঁটপাট, বাসন মাজা সে মা-ই করে মিনুর। ষোলো হওয়ায় মৌমাছিদের নজর পড়বে এ আর আশ্চর্য কি! কিন্তু তাবলে এবাড়িতে হাজির করতে হবে!

রান্নাঘরটা একটু একানে। নিজে নড়তে পারেন না তাই ওদিক পানে মাড়ান না। সেদিন বাসনের টুংটাং-এর সঙ্গে পুরুষ কন্ঠের হাসি শুনে ঘষটে ঘষটে মুখ বাড়িয়ে ছিলেন। মদনা না! মোড়ের মাথায় পান বিড়ি সিগারেটের দোকান। সে কি করে এবাড়িতে! মিনু তার শাড়ির আঁচল খসিয়ে ঢলে ঢলে পড়ছে। সঙ্গে হাসি। আর সহ্য হয়নি মহামায়ার। চিত্কার করেছেন। মদনা পগারপাড়। খুব ধমকেছেন মিনুকে। তারপর থেকেই বেসুরো বাজছে মিনু।

একমাত্র ছেলে মেরিল্যান্ড, আমেরিকায়। সেও প্রায় বছর দশেক। সেখানেই বিয়ে করেছে। বিয়ের পর একবারই এসেছিল। তাও বছর তিনেক আগে। এবাড়ির পরিবেশ নাকি বৌমার পছন্দ হয়নি। ছেলে কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনেছে বলে খবর পেয়েছেন। সেখানে তার শশুর-শাশুরি থাকে। ছেলে আসে কিনা জানেন না। এলেও ও বাড়িতে আসেনি। আগে মাসে মাসে টাকা পাঠাতো। এখন কালে ভদ্রে। বাবার পেনশনটা তো সময়মতন পাও, আমারটাতো জমানোই থাকে। ছেলের যুক্তি। মহামায়া নিরুত্তর।

এতটা পড়ে যদি মনে হয় নতুন কি আছে! অসংখ্য গপ্পো-উপন্যাসে এছবি পাওয়া গেছে! মহামায়াও সেটা জানেন। তাঁর জীবনে নতুন কিছুই নেই। শুধু ছাপার অক্ষরগুলো বড় কঠিন বাস্তব তাঁর ক্ষেত্রে। তাঁরও তো ওই একটাই নেশা। বই। গোপালই এনে দেয় পাড়ার লাইব্রেরি থেকে। লাইব্ররিয়ান মেয়েটিও বেশ। নিজেই বেছে বেছে বই পাঠায়। শনিবার টা হাফ। এসে মাসিমার সঙ্গে গল্প করে যায়। একটুরো বাইরের পৃথিবী মহামায়ার। চন্দ্রিকা। ভারী মিষ্টি মেয়ে। বিয়েতে নেমতন্ন করেছিল। মন নিয়েছিল। শরীর নিতে পারে নি। কাজে জয়েন করার দিন মিষ্টি আর শাড়ি দিয়ে গেছে চন্দ্রিকা। বউমার জন্য তুলে রাখা মকরমুখী বালা জোড়া দিয়ে আশির্বাদ করেছেন চন্দ্রিকাকে।

বলতে গেলে গোপালই তাঁর অভিভাবক। তাঁর সংবাদসংস্থা। দিনে বার দুই আসবেই। সারা পাড়া জানান দিয়ে। রিক্সা চালায়। নেশা ভাঙ কিছু নেই বলেই জানেন। তিনকূলে কেউ নেই। এখন কি একটা টোটো না কি বেরিয়েছে। শুনেছেন তাতে নাকি রিক্সা টানার কষ্ট নেই। ব্যাটারিতে চলে। লাভও নাকি বেশি। গোপালকে কতবার বলেছেন কিনে নে একটা।

-লাখ দেড়েক দাম। পাবো কোথায় ঠাকমা!

-লোন দেবে না কেউ? আমি না হয় তোর ডাউন পেমেন্টের টাকাটা দিয়ে দেব।

-থাক ঠাকমা। নিজের শেষ সম্বলটা আমায় দাও আর নিজে না খেতে পেয়ে মরবে আরকি! ছাড়োতো।

রাজী হয়নি কিছুতেই। সেই গোপালই ভরসা। সবেতে। ডাক্তার, ওষুধ, লাইব্রেরি থেকে শুরু করে মাসে একদিন পেনশন তুলতে ব্যাঙ্কে নিয়ে যাওয়া। মিনু আবার গোপালকে সহ্য করতে পারে না। ওর ধারনা ঠাকুমা ঠাকুমা করে আসলে বড় দাঁও মারার ধান্দায় আছে গোপাল। বস্তুত ওরা দুজনেই দুজনকে এড়িয়ে চলে। মহামায়া আন্দাজ করেন তার পিছনে অন্য একটা কারনও আছে। গোপালের হাবেভাবে কথা বার্তায় টের পেয়েছেন হৃদয়ঘটিত দুর্বলতা আছে গোপালের। মিনু পাত্তাতো দেয়ইনা উপরন্তু অকথা কুকথা বলতেও ছাড়ে না। তাই এড়িয়ে চলাই ভাল পন্থা।

অনেকক্ষন থেকে একটা কাক তারস্বরে ডেকেই চলেছে। আজকালতো আর অন্য পাখির ডাক শোনাই যায় না। একসময় বাড়ির উঠোনে এক্কাদোক্কা খেলতো চড়াইয়ের দল। তারাও মহামায়ার মায়া ত্যাগ করেছে। বসন্তের কোকিলের ডাক তো স্বামী মারা যাবার আগেই বিলুপ্ত। সরকারি চাকুরি করতেন। খুব দিলখোলা ছিল মানুষটার। খেতে আর বেড়াতে ভালবাসতেন। বছরে দুবার বেড়ানো বাঁধা ছিল। কত জায়গায় গেছেন মাহামায়া। কাশ্মির, সিমলা, নৈনিতাল থেকে কন্যাকুমারী, কোভালাম, গোয়া। প্রায় গোটা দেশটাই দেখা হয়ে গিয়েছে মাহামায়ার। এখন তাঁর দুনিয়াটা এই চারদেওয়ালেই বন্দি। মাসের এই একটা দিন ছাড়া। যত না টাকা তোলার প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি প্রত্যেকদিন বদলে যাওয়া চেনা পাড়াটাকে নতুন করে চিনতে চাওয়ার তাড়না।

মহামায়ার জীবনটায় অদ্ভুত মোচড়। যথেষ্ট বিদুষী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। একসময় লেখালেখিও করতেন। তারপর একটু একটু করে চেনা পৃথিবীটা কিরকম হাতের বাইরে চলে গেল। অনেকক্ষন থেকে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মহামায়ার। না হতাশা তাঁর নেই। জীবনের এই পরিবর্তনকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছেন অন্য ধাতুতে গড়া মাহামায়া। তাই ছেলের ব্যবহারে সামান্য কষ্ট পেলেও সেটা অপ্রত্যাশিত মনে হয়নি। ছেলের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আত্মীয় স্বজনের আনাগোনায় ভাঁটা পড়েছে। যবে থেকে চলাফেরার শক্তি গেছে পারতপক্ষে আর কেউ মাড়ায় না এদিক। কি জানি পাছে যদি দায়িত্ব নিতে হয় বুড়ির। বুড়িই তো! আসছে মাঘে ছেষট্টি হবে। চিকিত্সা চলছে তবে ডাক্তার বলেই দিয়েছে স্বাভাবিক চলতশক্তি আর ফিরবে না। হুইল চেয়ার নিলে হয়। নেওয়া হয়নি। হাত-পা জবাব দিলেও মাথা পরিষ্কার। অন্য বয়ঃজনিত রোগভোগও বিশেষ নেই। গোপালও বলে। ‘ঠাকমা চেয়ার গাড়ি কেনো। রোজ বিকেলে হাওয়া খাইয়ে আনবো।’ মনে হচ্ছে এবার নিতেই হবে। তবে তার আগে গোপালকে বলে বাড়িতে মিস্ত্রী লাগাতে হবে। চৌকাঠগুলো ভাঙাতে হবে। অনেক কাজ। কিন্তু গোপালটার হল কী! এতক্ষনে চলে আসা উচিত।

ভাবতে ভাবতেই সাড়া পাওয়া যায় গোপালের। পাঁজাকোলা করে গেটের সামনেই দাঁড় করানো রিক্সায় তোলে গোপাল মহামায়াকে। পাড়া প্রতিবেশীদেরও মাসে এই একটাই সুযোগ খোঁজখবর নিচ্ছে জাহির করার। মনে মনে বিরক্ত হলেও মাহামায়া মুখে প্রকাশ করেন না। প্যাডেলে চাপ দেয় গোপাল। চাকা গড়ায়। দৃশ্যান্তর হতে থাকে।

‘কেমন আছেন?’ ‘ছেলে কবে আসছে?’ প্রভৃতি অবান্তর প্রশ্নের জবাব দিয়ে এবং না দিয়ে এগোতে থাকে গোপালের গাড়ি।

-ঠাকমা, একটা নতুন ঝামেলা হয়েছে গো।

-কী হল?

-এই সময়টায় জিটি রোডে রিস্কা নো এন্টি করে দিয়েছে।

-চল না, বুড়ি মানুষ। পুলিশকে বুঝিয়ে বললে নিশ্চয় বুঝবে।

  • তা ঠিক বলেছো ঠাকমা। তাছাড়া তুমি বললে না শুনে যাবে কোথায়।

হাসতে হাসতে বলে গোপাল। রিক্সা হাজির হয় জিটি রোডের মুখে। ট্রাফিক জট এড়িয়ে বাঁদিকে নিতে চায় গোপাল রিক্সাকে। প্রায় শ’তিনেক মিটার দূরে ব্যাঙ্কের গেট। গাড়ি বড় রাস্তায় তুলতেই এগিয়ে আসে পুলিশ।

-এই হারামজাদা জানিস না, এখন রিক্সা যাবেনা?

-ঠাকমা হাঁটতে পারে না গো। ব্যাঙ্কে যাবে। পেনশন তুলতে।

-দুটো থেকে চারটের মধ্যে আসবি।

-বাবা তখন তো ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যাবে। বৃদ্ধ মানুষ একটু ছেড়ে দাও।

এবার কাকুতির সুর মাহামায়ার গলায়।

-আপনি বৃদ্ধ বললে আমার বড় কর্তারা শুনবে? যারা নিয়ম করেছে তাদের বলুন।

নিজের কর্তব্যে অনড় ট্রাফিক পুলিশটি। লোকজন জমতে শুরু করে। মিশ্র মন্তব্য ভাসে বাতাসে। ‘আহা একটু ছেড়ে দিলে ক্ষতি কি?’ ‘বয়স হয়েছে বের হওয়ারই বা দরকার কি?’ ‘একজনকে ছাড়লেই সবাই যেতে চাইবে।’…..

হঠাত্ই যেন গোপালের রোখ চেপে যায়। কোনোদিকে না তাকিয়ে জোর করে রিক্সা তোলে জিটি রোডে। রোখ চেপে যায় পুলিশেরও। এগিয়ে এসে সপাটে এক চড় কষায় গোপালকে।

মুহুর্তে নিশ্তব্ধ জমজমাট শিবপুর ট্রামডিপোর মোড়। এরপর বীর পুঙ্গব ট্র্যাফিক পুলিশ হাওয়া খুলে দেয় রিক্সার তিনটে চাকারই। উপস্থিত জনতা হঠাত্ ফাঁকতালে মজা লুটতে ব্যস্ত। সঙ্গে রসালো সঙ্গত। বড্ড অসহায় লাগে মাহামায়ার। গোপালকে মারার জন্য রাগও হয়। নানান রকম মন্তব্যে কান গরম হয়ে উঠতে থাকে। চড় খেয়ে হতভম্ব গোপাল সামলে নেয় নিজেকে। শক্ত হয় চোয়াল। আচমকাই দুহাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয় মাহামায়াকে। দৃঢ় অথচ অস্ফুট বিড়বিড়নি শোনা যায়, ‘শালা ঠাকমার নাতি এখনও জিন্দা আছে।’ হাঁটা দেয় ব্যাঙ্কের দিকে। ঝাপসা হয়ে আসে মাহামায়ার চোখ। এভাবে অসহায়তার মুহুর্তে কই কেউ তো আগে হাত বাড়িয়ে দেয়ে নি। স্বামী ছাড়া।

দর্শকদের মধ্য তখনও একটার পর একটা মন্তব্য। কেউ শিষ দিয়ে ওঠে। সব অস্পষ্ট ঠেকে মহামায়ার। তখনই কানে বেজে ওঠে কোনো এক রসিকের মন্তব্য।

-শালা পুলিশের চড় তো দেখেছি। কিন্তু পুলিশের গালে রিক্সাওয়ালার এমন অদৃশ্য চড় আগে দেখিনি রে……..

টপ টপ করে দুফোঁটা গরম নোনতা জল গড়িয়ে পরে মহামায়ার দুচোখের কোন ঘেঁষে। গাল বেয়ে।

মায়াবিনী মহুয়াডাঁর

কলির আর ফেরা হল না। হল না অনামিকার জন্যই। বেতলার সকালে ব্যর্থ ব্যঘ্র দর্শনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর (বেতলা ও অনামিকা) কলি স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছিল কলকাতায় ফেরার জন্য। কিন্তু অনামিকার সাফ কথা, সে লোধ ফলস না দেখে ফিরবে না।

আসলমই সারথী। পই পই করে সাবধান করেছে পুলিশি এসকর্টে যেন রাজী না হই। তাতে আরও বেশি এমসিসি-র কোপে পড়ার সম্ভাবনা। বেতলা ছাড়িয়ে মহুয়াডাঁড়ের রাস্তার মুখেই চেকপোস্ট। সার দিয়ে অপেক্ষায় ছোটো বড় যান। সিআরপিএফ সঙ্গে নিয়ে পার করে দেবে গাড়ু পর্যন্ত। আমরা আগেই যেতে চাই। গার্ডও যেতে দেবে না, আমরাও নাছোড়। হঠাত্ই এক উর্দিধারী এসে শমন ধরালেন ভিতরে তাঁর বড়কর্তা নাকি আমাকে ডাকছেন। বিরক্ত হলেও নামলাম জিপ থেকে।

-আইয়ে মুখার্জিদা, আইয়ে। ক্যায়সে হ্যাঁয় আপ?

হঠাত্ সিআরপিএফ কর্তার মুখে নিজের নাম শুনে বেশ চমকিত। ঘরের অল্প আলোয় চোখ সইতে রহস্যভেদ। সিংজী। একসময় দমদম বিমনবন্দরে পোস্টিং ছিলেন। আলাপ তখনই। চায়ের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলাম। রওনা হতে চাই। সিংজীর বক্তব্য উনি আমাকে দেখেই বুঝেছিলেন আমি একাই যেতে চাই। তাই নিজের সেল নাম্বার দিয়ে সাবধান করলেন। আর বিপদে ফোন করতে বললেন। ফেরার সময় পূর্ব ছিপাদোহরে ওনার ব্যারাকে স-সঙ্গী চাপানের আমন্ত্রণও জুটল।

সিংজীর নির্দেশে ডান্ডা উঠল গেটের। আমাদের যাত্রা হল শুরু। যদিও সিংজীর আমন্ত্রণকে পত্রপাঠ নাকচ করেছে আসলম। ওর যুক্তি বেশ সবল এবং সরলও বটে। আমরা আজ বাদে কাল চলে যাব। এমসিসি-র চর সর্বত্র। তারা যদি জানে আসলাম সিআরপি ব্যারাকে যাচ্ছে তাহলে ওর বিপদ হবে। ওকে গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে হয়। সর্বসম্মতিক্রমেই আসলমের যুক্তি পাস হয়ে গেল।

সরু পিচ রাস্তা কখনো সোজা কখনো বা এঁকে বেঁকে দুপাশে জঙ্গলকে সঙ্গী করে চলেছে। মাঝে মাঝে ঘনত্ব কমে। চোখে পড়ে ঘর বাড়ি। বেশিরভাগই মাটির। ছড়ানো ছিটনো। বনবস্তি। এ রাস্তা মহুয়াডাঁর পর্যন্ত গিয়েছে। সেখান থেকে ডাইনে গেলে লোধ ফলস্, বাঁয়ে চলে গেছে নেতারহাট। তবে সে এখন বহু দূর। জিপে সবাই চুপ। মন মজেছে জঙ্গলে।

অনামিকা শান্ত, সমাহিত। কলির মুখে বিষন্নতা। মাঝে মাঝে শুধু আসলমের কথা। নিপুন গাইডের মতন নানান তথ্য দিচ্ছে পথের। বেতলা, পূর্ব ছিপাদোহর রেঞ্জ পিছনে ফেলে প্রবেশ করতে হবে গাড়ু রেঞ্জে। তার জন্য পার হতে হবে কোয়েল। ব্রিজ আছে। পাকা ব্রিজ। গাড়ি থামল। যাত্রীদের অনুরোধেই। দুদিকের প্রকৃতির অনুষঙ্গে একটু থাকার ইচ্ছে। ব্রিজের তলা দিয়ে সামনে খানিকটা গিয়ে ডাইনে বেঁকেছে কোয়েল। তারপর হারিয়ে গেছে জঙ্গলের আড়ালে। দুদিকের জঙ্গল পরম যত্নে ঘিরে রেখেছে তাকে। তার বুকে ক্ষতের মতন ছড়ানো বালির চর। শীতের দিনে তার যৌবনে ভাঁটা পড়ে যে। হঠাত অনামিকা দৃষ্টি আকর্ষণ করল ব্রিজের ঠিক নিচে বালির চরের দিকে।

খালি গা। পরনে হেঁটো ধুতি। হাঁটু গেড়ে বসে দু হাত দিয়ে বালি খুঁড়ছে। খানিক পরেই সেই গর্ত ভরে উঠল জলে। তাতে ঠিক চতুষ্পদ প্রাণীর মতন মুখ ডুবিয়ে জল খেতে শুরু করল মানুষটি!

বেশ অবাক হলাম! আসলম ফাঁস করল রহস্যটা। এরা বনে যায় কাঠকুটো সংগ্রহ করতে। তারপর তৃষ্ণা পেলে নদীর চরে বালি খুঁড়ে জল পান করে। পরিশ্রুত জল। যেহেতু এখন জল কম। তাই নদীর জল আঁজলা ভরে তুললে তাতে বালি বা নোংরা মিশে থাকার সম্ভাবনা প্রবল। তাই এই ব্যবস্থা!

নীল ডেনিম আর হাল্কা সবুজ টি-শার্টে অনামিকার সৌন্দর্য যেন আরও বেড়েছে। একমনে তাকিয়ে সে অদূর নদীবাঁকের দিকে। কয়েক গোছা অবাধ্য চুল মুখের উপর আঁকিবুকি কাটায় ব্যস্ত। পাশে দাঁড়ালাম। রেলিং-এ হাত রেখে। হাতের উপর আলতো করে নিজের হাত ছুঁইয়ে অনামিকা চলে গেল জিপের দিকে। আমি নির্নিমেষ! মনে মাদকতা। হৃদস্পন্দন একটু দ্রুত হল কি! এভাবেই বোধহয় কোয়েলের কাছে ফিরে আসতে হয় একটু উষ্ণতার জন্য!

পাশেই গাড়ু রেঞ্জে পিডাব্লিউডির হলুদ বাংলো। বুদ্ধদেব গুহ এ বাংলোতে বহুবার থেকেছেন। এমনকি কোয়েলের কাছে বইটি নাকি এখানে বসেই লেখা। সগর্বে জানাল আসলম। তথ্য শুনে কলি আপ্লুত, অনামিকার ঠোঁঠে এক চিলতে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি।

চাকা গড়ায়। ক্ষনিক লোকালয় পার করে আবার সবুজের আলিঙ্গনে। চরিত্রেও সামান্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত। ঝোপঝাড়ের সংখ্যা কমছে। বাড়ছে মহিরুহদের উপস্থিতি। আকাশ নজরে আসে সামান্যই। সেখানে নীলের বদলে কাজল-কালো ছোঁয়া। বুনো গন্ধের সঙ্গী হল জলীয় বাষ্পের দল। অসময়ে কি ভেজাবে হৃদয়! মনের আকুতি পিছনের সিটে অনামিকার বাহুলগ্না হতে। চেতনার অগ্নিচক্ষুতে নিমেষে সংযত।

  • মাওবাদী, সাবধান।

কলির আতঙ্কিত কিন্তু তীক্ষ্ণ ফিসফিসানিতে চমক ভাঙে। ওর ভয়ার্ত দৃষ্টির অনুসরনে জঙ্গলের স্তব্ধতাকে ভেঙে খান খান করে অনুরনিত হয় অট্টহাসি। আসলম বিহ্বল চোখে তাকায়। গাড়ি থামানোর ইঙ্গিত। নেমে খানিকটা পিছনে যেতেই বাকিদের কাছে উন্মোচিত হয় মাওবাদী রহস্য। পথের ধারেই খানিকটা সাফসুতরো স্থান। কয়েকটি পাথর প্রোথিত মাটির উপর। তার চতুর্দিকে বাঁশের ডগায় পতপত করে উড়ছে তেকোনা লাল নিশান কতগুলি। যা মাওবাদীদের পতাকা সন্দেহে কলির ভীত হওয়া। স্থানীয় আদিবাসীদের মন্দির। খোলাই। নানান কারণে পূজিত এই নাম না জানা লৌকিক ভগবান। হাতির ভয়। বাঘের ভয়। অনাহারের ভয়। আর হ্যাঁ, ভুতের ভয়। দারহা ভুত। আসলমের কথায় মনে পড়ে গেল বুদ্ধদেব গুহর লেখায় পঠিত দারহা ভুতের কথা। দারহা। ভুত কিন্তু ভুত নয়। মানুষ। ভল্লুকের আক্রমণে বেঁচে যাওয়া দুর্ভাগা মানুষ। পরিবার যাদের ত্যাগ করেছে। রাতের অন্ধকারে তাদের বিভত্ষ ক্ষতবিক্ষত চেহারাই তাদের ভুতের পরিচয় দিয়েছে। জীবন্মৃত মানুষ। নিরীহ এই মানুষ ভুতের ভয় থেকে বাঁচতেই পুজো।

হঠাত্ টুপফোঁটাদের আগমণ। ভিজতে সাধ হয়। সাধ হয় অনামিকারও। ভয় সরিয়ে সঙ্গী হতে চায় কলি। সেই সাধে বাধ সাধে আসলম। অনেক দূরের পথ। এভাবে চললে ফিরতে রাত হবে। ভয়টা সেই অন্ধকারকেই। পলামুর জঙ্গলের সেই অন্ধকার। সেখানে দারহার থেকেও বিপজ্জনক কোনো শ্বাপদ অথবা এমসিসি নামধারী দুষ্কৃতি। যারা বিপ্লব নয় নাম ভাঙিয়ে ডাকাতিতেই বেশি উত্সাহী। সদ্য ঘটেওছে কয়েকটি ঘটনা। অগত্যা চরৈবেতি…।

গাড়ু রেঞ্জ ছাড়াতেই বাড়েসাঁড় রেঞ্জ শুরু। জিপ তখন পাহাড়ি ঢালে। আবার পরিবর্তিত জঙ্গলের চরিত্র। বাঁশঝাড়ের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে। কচি বাঁশের কোর হাতির প্রিয়। আসলম জানায়। এ অঞ্চলে হাতির উপস্থিতি প্রায়ই চোখে পড়ে তাই। নিসর্গ মন ভোলায়। আরণ্যকের অভিযানে অনাবিল আনন্দ।

সামনে বাঁক। মোড় ঘুরতেই সশব্দে ব্রেক কষে আসলাম। শিহরণে চমকিত রোমকূপ। গাছের গড়ানে গজেন্দ্র গমণে গতিহীন গাড়ি। হ্যাঁ, হাতিতে হারিয়েছে হতবাক হঠকারিরা। হঠকারিই-তো। না হলে জঙ্গলে হঠাত্ গতির কী প্রয়োজন? চোখ সজাগ। মন রোমাঞ্চিত। ভ্রূক্ষেপ নেই গজাধিপতির। ট্র্যাফিক পুলিসের একাগ্রতায় দলীয় কমরেডদের পথ পার করাতেই ব্যস্ত। টুপফোঁটারা তখন মৃদুমন্দ বরিষণ। সংখ্যার হিসেব হারিয়ে যাওয়া গজযূথের দলবদ্ধ পেশি সিঞ্চনে পিছলে যায় জলকণা। কী রূপ! কী-ইবা তার লাবণ্য! কী তাচ্ছিল্যই না উপচে পড়ে! সীমাহীন ঔদ্ধত্যে! জঙ্গল-তো মানুষের থেকেও ওদেরই বেশি। সভ্যতা আর সীমাহীন বুদ্ধির গরিমায় অন্ধ মানুষ কি মনে রাখে?

সময়ের হিসেব থাকে না। শুধু থাকে মুগ্ধতা। কাঁধে নরম স্পর্ষ। অনামিকা। শেষবার থামার পর সম্ভবত সই-য়ের সঙ্গে যোগসাযোসে আমার পিছনে। ভাল লাগে। সাহসী হয় মন। নির্দ্বিধায় কাঁধে চলে যায় হাত, আনমনে। সবাই হাতিতে মগ্ন। সময় কোথায় সময় নষ্ট করবার। রাতের সব তারাই তাই দিনের আলোয় উজ্বল।

এক সময়ে পার হয়ে যায় হাতি। আসলমের কুশলী হাতের তত্পরতায় গতি পায় যান। মন বলে এত তাড়া কিসের গজযূথের! আসলে গতিপ্রাপ্ত গাড়ি যে দূরত্ব তৈরি করে আবার। কলি কি মুচকি হাসে! আবার সরে সরে যায় বন। গান শোনায় হাওয়ারা। “অ্যায়সা শামা না হোতা, কুছ ভি ইঁহা না হোতা, মেরে হমরাহী যো তুম না হোতে…”। এবার গান অনামিকার। এবার অর্থপূর্ণ হাসি কলির। ‘কেয়া খুব’ মন্তব্যে গাড়ি আর গানের তালে মাথা দোলায় আসলম। ইচ্ছে করে থেমে যাক সময়।

“মৌসম ইঁয়ু না গাতা, ইঁয়ু না গাতি ইয়ে হাওয়া..’। গানের সুরে সুরে নিরন্তর চলে যাওয়া। বেগ পায় টুপফোঁটারা। ঘন হয় হাওয়া। গানের সঙ্গতে। মুহুর্তে পলামু বদলে যায় নন্দন কাননে। মার্ক টোয়েন থাকলে নিশ্চয় ভুল স্বীকার করতেন। “মরিশাস নয় পলামু দেখেই ঈশ্বর নন্দন কানন সৃষ্টি করেছেন”।

হঠাত্ গতিহীন হয় গাড়ি। কারন জানায় আসলম। বাঁধানো পথ ছেড়ে ডানপন্থী হতে হবে। সেখানে আছে ছোট্ট কিন্তু মিষ্টি এক ঝণর্া। সুগা বাঁধ। স্থানীয় ভাষায় সুগা শব্দের অর্থ টিয়া পাখি। দিনের পর দিন টিয়া পাখিদের ঠোঁঠের ঠোক্কোরে নদীর পথ পরিবর্তিত হয়ে নাকি সৃষ্টি এ ঝর্ণার! কাঁকুড়ে পথে চাকার ঘর্ষণে ওঠা সুর থামে। পৌঁছেছি সম্ভবত। জিপ থেকে নামতেই চমক। হাড়হিম চমক। প্রস্তুতি ছিল না যার বিন্দুমাত্র। প্রায় ভূতের মতন আসপাশের ঝোপঝাড় থেকে জনা চারেক মুখ ঢাকা মানুষের উদয়। হাতে বন্দুক। তাদের পরিচয় জিগ্যেশ করে জানার প্রয়োজন নেই। বন্যপ্রাণ না হোক এমসিসি দর্শন চাক্ষুশ। কলি দৃশ্যতই আতঙ্কিত। অনামিকা ফ্যাকাশে। আসলমও তাই। স্থানীয় ভাষায় আসলমকে কিছু প্রশ্ন করে এক বন্দুকধারী। উত্তর দিয়ে আমার দিকে ফেরে আসলম।

  • সাব, আপলোগোঁকে বারে মে পুছ রহে হ্যাঁয়।

  • ম্যায় এক পত্রকার হুঁ। ট্যুরিজম পর লেখ লিখনে আয়া হুঁ।

সরাসরি উত্তর প্রশ্নকর্তাকে।

  • ইঁহাপে কিসলিয়ে আয়ে হো?

প্রশ্নকর্তার সুরে ধমক প্রকট। ঘাবড়ালেও প্রকাশ করা চলবে না। যতটা সম্ভব গলাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা।

  • সুগা বাঁধ দেখনে অউর ফোটো লেনে আয়ে হ্যাঁয়। আপকা এরিয়া কমান্ডার ইয়া কোই ভি সিনিয়র কমরেড সে বাত হো সকতি হ্যায় কেয়া?

এ প্রশ্নে বিষ্মিত হল কিনা বন্দুকধারীরা বোঝা যায় না মুখ ঢাকা থাকায়। নিজেদের মধ্যে আলোচনা সারে জনান্তিকে।

  • কোই আই ডি বগেরা হ্যায় কেয়া?

আবার কর্কশ প্রশ্ন। গভর্নমেন্ট অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড (আমার সচিত্র সরকারি সাংবাদিক পরিচয়পত্র) বের করি। কার্ডটা প্রায় ছিনিয়ে নেয়। আবার আদিবাসী ভাষায় খানিক শলা-পরামর্শ। আমার কার্ড হাতেই জঙ্গলে নিমেষে মিলিয়ে যায় একজন। বাকি তিনজনের একজনের ইঙ্গিত মহিলাদের জিপে উঠে বসার জন্য। আমরা দুজন বাইরে দাঁড়িয়ে। জিপের দিকে মুখ করে। দুজনেরই দুহাত তাদের নির্দেশে বনেটের উপর। পিঠে বন্দুকের নলের স্পর্শ। নিঃশব্দ সময় গড়ায়। বন্দুকধারীরাও পাহারায় নিশ্চল। শুধু প্রাকৃতিক শব্দ। সঙ্গে দূর থেকে ভেসে আসা ঝর্ণার ঝিরি তান।

কতটা সময়! এক ঘন্টা! দুই! তিন! নাহ্, অত না। তবে সময় ঠিক যখন অসহনীয়, তখনই আবির্ভাব। একা নয় চারজন। সবার পিঠেই সেমি-অটোমেটিক। আবার নির্দেশ। এবার কি একটু মোলায়েম!

  • চলিয়ে। সব কোই।

গাড়ির নিরাপত্তা প্রসঙ্গে আসলম বোধহয় কিছু বলতে চায়। জবাবে জোটে পাঁজরায় বন্দুকের খোঁচা। কলির মুখ দেখে বলির আগে ছাগলের মুখের অনুষঙ্গ মনে পড়তে পারে। অনামিকা ভাবলেশহীন। অবাক হতে হয়।

প্রায় তিন-চার সিঁড়ির স্টেপ জাম্পে এক একটা ধাপ। বোল্ডারের। কোথাও বেশ মসৃণ। পাহড়াদারদের হাতে বাহুবন্দি না থাকলে পতন নিশ্চিত। খানিক কসরত। তারপর ঢালু মস্ত এক পাথরের অমসৃণ পথ। পাথর না বলে ছোটোখাটো পাহাড় বলাই যায়। অনেকটা নিচে প্রায় জনা পঞ্চাশের জমায়েত। পরনে খাকি, গলায় লাল গামছা আর বলাই বাহুল্য পাশে শায়িত বন্দুক। দু-একজনের হাতে ম্যানপ্যাক বা ওয়াকি-টকি। ফিট দশেক তফাতে অল্পবয়সী এক তরুণ। ভাবেই প্রকট, এই দলনেতা। দলের অধিকাংশই তরুণ। কানে নিরবচ্ছিন্ন ঝর্ণার গান। অদূর পাথরের আড়ালে মাঝেমাঝেই উঁকি দেয়। নৃত্যরতা সফেন জলরাশি। খানিক তফাতেই উনুন। ছোটো তিনটে পাথর দিয়ে। জ্বালানী কাঠকুটো। ফুটন্ত ভাতের গন্ধ ধাক্কা মারে নাকে। নাকি উদরে!। বন্দুক না থাকলে পারফেক্ট চড়ুইভাতির ক্যানভাস।

  • Welcome Mr. Mukherjee, please have a seat. Don’t worry sisters enjoy our nature. Our Palamu.

দলনেতার আহ্বানে প্রমানিত হয় আন্দাজ সঠিক। আর seat মানে আদতে তার পাশের প্রস্তরপৃষ্ঠ। তবে চমকে যায় কান ইংরেজি উচ্চারণে। প্রায় নিখুঁত। কলি, অনামিকাও দৃশ্যতই বিহ্বল। কিন্তু সাংবাদিক কানে ঠিক ধাক্কা মারে দ্বিতীয় Our-এ অতিরিক্ত জোর দেওয়াটা। প্রথমে ইন্টারভিউ দিতে হয় অনাহুত অতিথিদেরই। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। বেশিটাই ইংরেজিতে। কিছু হিন্দি। অতঃপর প্রশ্নকর্তা আর উত্তরদাতার ভূমিকা বদল। আপাতত এটুকু জানানোই যথেষ্ট উনি এরিয়া কমান্ডার। বাকি লেখা নিস্প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই তা প্রকাশিত। তবে সন্তুষ্টি লাভের পরে ওনাদের সঙ্গে দ্বিপ্রাহরিক ভোজনে যোগ দেওয়ার শর্তেই মিলেছিল ইন্টারভিউ এবং মুক্তি লাভের অনুমতি।

“দানে দানে পে লিখা হোতা হ্যায় খানেওয়ালো-কা নাম”। সত্য বারবারই প্রমানিত হয়। এভাবেই। আয়োজন নেহাতই সামান্য। মোটা লাল চালের ভাত। অসাধারন তার স্বাদ। আর দিশি মুরগির ঝোল। না আছে আলু, না মশলার বাড়াবাড়ি। কি অসাধারন উপাদেয়। বনভোজন সার্থক। কলি বাদে সবাই প্রায় হাপুশ হুপুশ। কলির টেনশন খানিকটা বিদ্যমান। শুরুতে কর্কশতা থাকলেও পরবর্তীতে তুলনাহীন আতিথেয়তা। আত্মীয়-বন্ধুর বাড়িতেও কম জোটে। আসলমকে তার জীপের নাম্বার দিতে হল। অন্য কোনো কারনে নয়। আমাদের নিরাপত্তার জন্য। কোথাও বাধা পাব না আর। তবে পুলিশ সঙ্গ? নৈব নৈব চ!

আবার চলা শুরু। এবার আর বন্দুকের খোঁচা নয়। করমর্দন। যদিও শহুরে হাতে তাও কর্কশই ঠেকে!!

প্রকৃতি রূপ বদলায়। জঙ্গলের ঘনত্ব কমতে থাকে। প্রকট হয় মালভূমি। গাছপালা সরে যায় দূরে। টিলা আর লালচে পাথুরে ঢেউ। অন্য অনুভূতি। চোখের রিলিফ। আসলম হঠাত্ খুশ। কলি সামান্য স্বাভাবিক! সুরের হদিশ মেলে অনামিকার গলায়।

‘আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব, হারিয়ে যাব আমি…’

পারিপার্শিকতা ভূলে সব কিছুই হারিয়ে যেতে থাকে গতিময় গাড়ির নিরন্তর ঘুর্ণায়মান চাকার ভ্রমরে।

  • সাব, চায় পিয়া যায়?

আসলমের কন্ঠে ঘোর কেটে বর্তমান। এক তেমাথার মোড়ে দন্ডায়মান যান। সামনেই দিগনির্দেশ। ক্রিপ্টোলজিস্ট না হয়েও উদ্ধার করা যায়, বামে ঠিক কতটা পথ পেরোলে তবে নেতারহাট যাওয়া যায়। আর ডানে, বহুপ্রতিক্ষিত লোধ ফলস্-এর ঠিকানা লেখা।

সামান্য বিরতি। চা-পান। এবং দক্ষিণপন্থী হওয়া। আর দূর নেই ফলস্-এর বেশি দূর নেই, সব ক্লান্তির অন্ত এবার।

আবার ঘনিয়ে আসে বৃক্ষরাজি। হাওয়া বয়ে দ্রুত। বাতাসে ঠাণ্ডা ভাব। পিচের রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় জিপ। চাকায় শব্দ ওঠে। তাই দশ কিলোমিটার দূর থেকে যে প্রপাতের আওয়াজ পাওয়া যায় তা কানে এলো অনেক পরে। জঙ্গল ঘেরা আঁকা-বাঁকা পথ হঠাত্ শেষ। প্রপাতের শব্দ তীব্র। খানিকটা হাঁটতে হবে। তবেই দর্শন।

  • ও-য়া-ও!

কলির অভিব্যাক্তি। প্রপাত দর্শনে। লোধ ফলস্‌। ঝাড়খণ্ডের সর্ব্বোচ্চ। ভারতের একুশতম। উচ্চতা ৪৬৯ ফিট। বুঢ়া নদীর পতন। ছত্তিশগড় থেকে ঝাড়খণ্ডের বুকে। তাই এই প্রপাতের আরেক নাম বুঢ়াঘাট। নিচ থেকে প্রপাতটি পুরো দেখা মুশকিল। সরাসরি পতন নয় যে। ধাপে ধাপে নেমেছে। তাই বুঝি এত রূপসী সে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে খানিক। তাতে মিলবে তার রূপের অন্য বাহার।

  • যাক, বেতলা আসা সার্থক হল।

অনামিকার পরিতৃপ্তি। কিন্তু এতক্ষনে সহজ হওয়া কলি সখীর ঠ্যাং টানতে কসুর করে না।

  • তোর তো ভাই আগেই সার্থক হয়েছিল। বরং আমার হল বলা যায়।
  • ও, রাতে জঙ্গলে হাতি আর বাইসন দেখার কথা বলছিস?

  • না, ভাই। কেচকির বাঙলোয় জিপ থেকে নেমে অরিন্দমদা-কে দেখার কথা বলছি।

খিলখিলিয়ে ওঠে কলি। অনামিকের চোখে ছদ্মরোষ। গাল গোলাপী। অপাঙ্গে তাকায় একবার। আমিও যেন খানিক অপ্রস্তুত কলির এহেন প্রগলভতায়। আসলম-ও বোধহয় দাড়ির ফাঁকে হাসি লুকোয়। গম্ভীর হয়ে প্রকৃতিতে অবগাহন করি। অবিরল শব্দের সাথে জলধারার পতন। গায়ে এসে হাত বোলায় জলকণার দল। সিক্ত করে। মনও সিক্ত হয়। এই সৌন্দর্য ছেড়ে ফিরতে মন চায় না। উপায় নেই। আঁধার নামার আগেই ফিরতে হবে। আসলম আর কলি আমাদের একা হওয়ার সুযোগ দিয়ে নেমে যায়। ঘনিয়ে আসে অনামিকা। নির্দ্বিধায় হাতের মুঠোয় তুলে নেয় হাত। মাথা রাখে কাঁধে। দুজনেরই চোখ অপরূপা লোধের দিকে। সময় থমকে যায়।

মন হারালেও আমাদের হারানোর উপায় নেই। ফিরতেই হবে কংক্রিটের জঙ্গলে। মায়াবিনী মহুয়াডাঁরের স্মৃতিটুকু শুধু থেকে যাবে অমর হয়ে। যেমন থেকে যাবে থমকে যাওয়া এই সময়।

পাহাড়ি পথের পাঁচালি

পড় পড় হে পাঠকগণ, পড় দিয়া মন।

পাহাড়ি পথের পাঁচালি করিব বর্ণন।।

   মুখ-বন্ধ- কর্মসূত্রে বিভিন্ন সময় নানান জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে এমন অনেক কিছু নজরে এসেছে যা সেই ঘোরা বৃত্তান্তের ভার বাড়াবে মনে করে আর লেখা হয়নি। সেই সমস্ত অলিখিত ঝিনুক দিয়ে মালা গাঁথবার বাসনা। পাঠকের রায় শিরোধার্য। নামেই প্রমাণ বৃত্তান্ত পাহাড়ি পথের। তবে বিষয়ের অবতাড়না শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গ আর সিকিমের পাহাড়ি পথ নিয়ে। কেন? এখনি না বললে মহাভারতের কোনো অধ্যায়-এর শুচিতা নষ্ট হবে না। কষ্ট করে পুরোটা পড়ে ফেললে কেষ্ট লাভ না হলেও কারনটা জানা যাবে।

   জাতীয় নরক!!! সেবার। কালী পুজোর পর। হঠাত্‌ অমুর ফোন। অমু মানে অমল। আমার একসময়ের ক্লাস ফ্রেন্ড। ও ওর ছোটো পিসিকে নিয়ে দার্জিলিং আসছে। আমাকেও যেতে হবে। ছোটো পিসি। মানে কালী পিসি। ওরেব্বাবা। প্রায় ভূ-পর্যটক। যাইহোক, যেতে হবে মানে, যেতে হবেই। অগত্যা! নির্দিষ্ট দিনে শিলিগুড়ি থেকে ওদের একান্ত আপন গাড়িতে। সবে রোহিনী টোল-প্লাজা পার হয়েছে গাড়ি। হঠাত্‌ কালী পিসির চিত্‌কার।

   – হ্যাঁরে, অমু? আমাকে কি দেকতে খারাপ?

   – কেন ছোটোপিসি?

   আমতা আমতা করে জবাব অমুর। দৃশ্যতই কনফিউজড।

   – বলি এ কেমন ধারা জাতীয় সড়ক?

   – কেন পিসি? ভালইতো রাস্তা।

   এবার অমুকে উদ্ধারে আমার পতন।

   – বলি অনামুখো, কে তোকে ট্যেভেল সামবাদিক বানিয়েছেল রে?

   আমরা চুপ। বোঝা যায় না ঘটনা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে। কালী পিসি তখন মুডে।

   – গাড়ি ওঠে আর দাঁড়ায়। উল্টোদিকের গাড়ির সারি না নামা অবদি, নট নড়ন নট চড়ন। এটা জাতীয় সড়ক? না, জাতীয় নরক? পাশাপাশি একটার বেশি গাড়ি যায় নেকো।

   – পিসি, পাহাড়ি রাস্তা তো

   থাম তোর পাহাড়ি রাস্তা। মাঝে মাঝেই দেখি এই চিত্তর। আমাকে পাহাড় দেখাস?

   – কালী পিসি এটা পাহাড়ি জাতীয় সড়ক যে.

   আমার মরিয়া প্রচেষ্টা।

   – অ্যাই ছোঁড়া শোন, উলবেড়ের কালী চক্কোত্তি-কে জাতীয় সড়ক চেনাস না। বাড়ির পিছন বাগে বোম্বের রাস্তা। এরকম ছটা রাস্তা ঢুকে যাবে।

   – আসলে পিসি এটা ঠিক জাতীয় সড়ক ন.

   – তবে যে অমু বলল এটা জাতীয় সড়ক ৫৫ না ৫৬?

   – ঠিকই বলেছে। ৫৬ নয়, ৫৫। তবে শর্টকাট বা বাইপাস বলতে পারো।

   শেষ মরিয়া চেষ্টা আমার।

   – বাইপাশ না ছাইপাঁশ! আমাকে শেখাস না রাজা। আমি ভূ-ভারত ঘুরিচি। কই লাদাক, সিমলে সেকেনে তো অমন নয়?

   – আসলে ওদিকের হিমালয় আর এখানকার হিমালয়ের চরিত্র আলাদা তো।

   – চরিত্তির দ্যাকাসনি।

   আমাকে এক ধমকে থামিয়ে দ্যান পিসি।

   – তোদের সবার চরিত্তির আমার জানা আছে। কেউ ধোয়া তুলসিপাতা নোস।

   এরপর আর তর্ক চলে না। পিসিকে বোঝানো ভগবানেরও অসাধ্য। এখানকার ভূ-প্রকৃতি ভয়ঙ্কর ধ্বসপ্রবণ হওয়ার জন্য টু-লেন রাস্তাকেও কোথাও কোথাও ওয়ান-লেন রাখতেই হয়। ভাল কথা। পিসি কিন্ত সত্যিই ভূ-ভারত চষে খেয়েছেন। এখনও তাঁর উত্‌সাহ অসীম।

   হর্ন-স অফ ডিলেমা- ভুনিদাকে মনে আছে আপনাদের? সেই যে আমার সঙ্গে মুঙ্গের গিয়েছিল (‘মুনির ঘর থেকে মুঙ্গের’। আনন্দবাজার। পরে আমার বই। তারপরে আমার ওয়ার্ডপ্রেস ব্লগ।) এবার আমার সঙ্গী। দুর্ঘটনাচক্রে আবার দার্জিলিং। এবং আবার সেই রোহিনী পথ। এবার আমরা নামার পথে। শিলিগুড়ি। যদিও এবার আমরা সওয়ার এনবিএসটিসি-র বাসে। ভুনিদা ড্রাইভারের পাশের সিটে। আমি ঠিক পিছনেই। মাঝেমাঝেই সরু এক-লেন রাস্তার জন্য জ্যাম হচ্ছে। এক জায়গায় সব সীমা ছাড়িয়ে দীর্ঘক্ষণের জন্য দাঁড়াল বাস। কারন? এক-লেন রাস্তা। কিন্তু সমস্যাটা অন্য। একটা হেভি লোডেড ট্রাক উঠছে। খুব আস্তে। ফলত পিছনে, গাড়ির সাড়ি দীর্ঘ। এর আগে ভুনিদা লক্ষ্য করেছে যে বাস আর ট্রাক যখন হঠাত হেয়ার-পিন বেন্ডের কাছে মুখোমুখি তখন প্রায়ই উল্টো দিকের গাড়ির চরিত্র না বোঝায় একটা জট তৈরি হচ্ছে। ফলে কাউক না কাউকে পিছতে হচ্ছে। রেজাল্ট? দেরি।

   ভুনিদার ধারনা। তাঁর মাথায় সবসময়ে ক্রিয়েটিভ আইডিয়া কিলবিলান্ত। সেগুলো নিলে রাতারাতি রাজ্য পঞ্চাশ বছর এগিয়ে যেত। আমাদের ঠেকের কোনো এক অর্বাচীন ভুল করে প্রশ্ন করে ফেলেছিল, যদি রাজ্যের বয়স ৫০ বছর বাড়ে তবে ভুনিদার কী হবে? উনি তো পঞ্চত্ব লাভ করেবন। কারন আর যাইহোক ভুনিদা এখন ৬০, রোগে ভোগে জরাজীর্ণ। সে আর খুব বেশি হলে বছর পাঁচেক। এসব শুনে সেদিন থেকে উনি মৌনি। তাই আজ আবার আইডিয়ার কথা শুনে আমি ফুট-ফুটান্তি।

   – কি করা উচিত মনে হয় তোমার?

   – সরকারের উচিত আলাদা রকম হর্ন-এর ব্যবস্থা করা।

   গম্ভীর মুখে নিদান দেয় ভুনিদা। আমার প্রায় আকাশ থেকে পতন। বলে কি!

   – কি রকম? একটু বুঝিয়ে বলবে প্লিজ।

   – দ্যাখ। গাড়ির চরিত্র তিনরকম।

   আবার চরিত্র নিয়ে টানাটানি! প্রায় আঁতকে উঠি। তবে মনে মনে। মুখে বললে যদি ভুনি বাবা আবার মৌনি হন। ভুনিদা বলে চলে।

   – এক, দু চাকার গাড়ি। মানে বাইক। ছোটো চার চাকার গাড়ি। মানে সুমো, স্কর্পিও, বোলেরো ইত্যাদি। আর বড় গাড়ি। যেমন বাস, ট্রাক, ম্যাটাডোর, ট্যাঙ্কার।

   – তো?

   – আ মোলো যা। এ ছোঁড়ার দেখি তর সয় না। বলতে দে না।

   ভুনিদা যারপরনাই বিরক্ত। আমি মুখে কুলুপ।

   – সরকার যদি নিয়ম করে এই তিন ধরনের গাড়ির জন্য নির্দিষ্ট তিন রকমের হর্ন-এর নিয়ম করে দেয় তাহলে কতো সুবিধে হয় ভাব।

   আমি অথৈ জলে। এ আবার কি বলে!

   – মানে?

   – মাথায় কি গোবর? সহজ কথাটা বুঝলি না! আরে হর্ন শুনে বাঁকের আড়ালে থাকা গাড়ির চালক বুঝে যাবে উল্টোদিকে কেমন গাড়ি সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। হাঁদা, এই সহজ সত্যটা বুঝতে এত সময় লাগে! সরকারেও সব তোর মতন মাথামোটার দল।

   আমি বাকরহিত। মুখে ভুনিদার বুদ্ধির তারিফ করলেও মনে মনে হেসে অস্থির হই। পরে কিন্তু মনে হয় আইডিয়াটা নেহাত মন্দ নয়।

   আয়নার বায়নায়- হর্নের ব্যবস্থা না করলেও পাহাড়ি হেয়ার-পিন বাঁকে বড় গোল আয়না কিন্তু বসানো হয়েছিল। উদ্দেশ একই। যাতে উল্টো দিকের গাড়ি দেখা যায়। কিন্তু সেবার গিয়ে দেখি বেশির ভাগ আয়নাই গায়েব। পড়ে আছে খাঁচাটা। দু-একটা খুলতে গিয়ে ভেঙেও গিয়েছে। বোঝা যায় বিলক্ষণ। নির্ঘাত স্থানীয়দের কীর্তি। তখনই ভুনিদার সংশয় প্রকাশ।

   – ভাই, পাহাড়িরা কি শেভ করার জন্য ওগুলো নিয়েছে? মানে, দরকার কি লাগে?

   আমি উত্তরহারা। তবে খবর্দার। আগেই বলে দিচ্ছি, নো পান ইন্টেন্ডেন্ট। ভুনিদার উক্তি থেকে পাঠক যদি দুষ্টুমি বুদ্ধি করে অন্য মানে করতে চান তার জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।

   তিস্তার বিস্তার- আবার কালী পিসি। আবার অমু। সঙ্গে আমি। এবার যাত্রা গ্যাংটক। সঙ্গী জাতীয় সড়ক দশ। আর পদে পদে ধস। তেমনই এক ধসে যাত্রা আরও একবার রুদ্ধ। যথারীতি পিসিমনি ক্ষুব্ধ। গাড়ি থেকে নিজেই পড়লেন নেমে। কারন দেখতে সরজমিনে। একেবারে রাস্তার কিনারে। তিস্তার দিকে চোখ। তারপরেই আমার উদ্দেশে তোপ।

   – অ্যাই ছোঁড়া, ইদিকে আয়।

   – কি হয়েছে পিসি?

   – বলি তোকে কোন গাড়লে সামবাদিক বানেয়েছিল, অ্যাঁ?

   পিসির এই এক দোষ। কথায় কথায় আমায় জাত তুলে গাল পাড়ে। গোঁজ হয়ে থাকি। উত্তর দিই না।

    – বলি তলে তলে দেশটাকে যে চায়নার হায়নাদের বিক্কিরি করার মতলব চলছে সেটা ঘটে ঢুকচে না?

    আমি আর অমু বেজায় অবাক। বলে কি? ধসের সঙ্গে চিনের কি সম্পর্ক! পিসির বয়স হয়েছে ঠিকই। তাবলে মাথাটা এতটা বিগড়েছে বোঝা যায়নি।

    – অমন হাঁ করে ঢ্যাঁড়শের মতন তাকিয়ে রইলি যে? বলি ঘটে কিছু ঢুকলো?

    পুতুলের মতন ঘাড় নাড়ি। নেতিবাচক।

    – বলি সিকিমটা চায়না কি চায় না? হাতে পেলে গড়গড় করে লাল ফৌজ ঢুইক্যে দেবে এদিক পানে। তকন কি হবে?

    পিসির কথা আমার মাথা তো দূর অস্ত, হিমালয়ের মাথাও টপকে যায়।

    – একটু বুঝিয়ে বলবে পিসি? ধসের সঙ্গে চায়নার কি সম্পর্ক।

    – আজকালকার ছেলে ছোঁকরাদের কি একটুও বুদ্দি-শুদ্দি থাকতে নেই!

    পিসিও বিস্ময়ে বাকরহিত আমাদের সীমাহীন মুর্খামি দেখে। তারপর যেন করুনাই হয়। ছোটো ছেলেদের পড়া বোঝানোর মতন আমাদের পাখিপড়া করাতে শুরু করেন।

    – খোঁজ নে কার বুদ্ধিতে তিস্তায় এতগুলো বাঁদ। তোদের ওই স্টিং না ডিং সেই অপরেশন কর। তালেই দেকবি ঝুলি থেকে বেড়াল বেরোবে। সে ব্যাটা নিচ্চয় চায়নার টাকা খেয়েচে।

    – মানে?

    – মানে আমার মুন্ডু। আরে বাবা একেনে রেজার্বার করার জায়গা আচে? নেই তো। তাইলে কোন আক্কেলে গন্ডমুর্খের দল পর পর এতগুলো বাঁদ দেয়! দেকচিস। জল কেমন জমে আচে! আরে জমা জল যে দুদিকে পাহাড়ের পাথর আর মাটি খাবে সেটা উলবেড়ের কালী চক্কোত্তির মগজে ঢোকে আর তোদের সরকার বাহাদুরের মাতায় ঢোকে না? ধস তো নামবেই। আরও নামবে। তোদের এই জাতীয় সড়ক থাকবে ভেবেচিস? আর এটা না থাকলে সিকিমের মানুষগুলো কি আঙুল চুষবে? ভেগে যাবে চায়নার দিকে। তকন বুজবি ঠ্যালা। মিলিয়ে নিস আমার কতা।

    পিসি ভাষন শেষ করে হাঁপাতে থাকে। আসপাশ বেশ ভিড় জমে গিয়েছে। তারমধ্যে কেউ কেউ বোদ্ধার মতন মাথা নেড়ে পিসিকে সমর্থন জানায়। আমরা দুজন অকুল পাথারে। যদি আপনারা বুঝে থাকেন আমাকেও একটু সরল বাঙলায় বুঝিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।

   অপ্রাসঙ্গিক- মনে হতেই পারে। তবে পথের কথা বলতে গেলে পথু বেপথু সবার কথাই আসা উচিত। তাই এবার তাহাদের কথা। এমনিতেই পাহাড়ে জীবন যাত্রা ঢিমে তালে চলে। তবে তা যে মাঝে মাঝে মাত্রা ছাড়াও হয় এ অভিজ্ঞতাও একাধিক। তেমনই কয়েকটি ঝিনুক।

   দাক্ষিণ্য- সেই যে সেবার। গিয়েছিলাম দুরপিনদাঁড়া। তিস্তার বিস্তার দেখতে। (মায়াধারী রোয়্যাক। ওয়ার্ডপ্রেস ডট কম)। তিস্তা ভ্যালি চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে ফেরার পথ। তখন লাঞ্চ টাইম। ওমা একি! সামনে কি দেখি! রাস্তা জুড়ে পলিথিন পেতে শুয়ে আছে বাগানের চা সুন্দরীর দল। কেউ বা মত্ত খোশ গল্পে। গাড়ি দাঁড়ায়। একবার অপাঙ্গে চেয়ে প্রথমে পাশ ফিরে শোয়। তারপর বোধহয় দয়া হয়। তাই দাক্ষিণ্য প্রদর্শন। উঠে বসে। আড়মোড়া ভাঙে। শেষে উঠে দাঁড়ায়। প্রথমে টিফিন কৌটোটা তুলে রাখে পথের পাশে। তারপর চায়ের টুকরি। অতঃপর জুতো জোড়া। তাড়া নেই কোনো বিশ্ব চরাচরে। এবার মন দিয়ে পলিথিনের শিট ভাঁজ করতে থাকে। আমাদের অনন্ত অপেক্ষা। কখন যেন শেষ হয় সে পর্ব। গাড়ির গতি প্রাপ্তিতে প্রাগইতিহাস থেকে আবার বর্তমানে ফেরা।

   মোট প্রায় সারে সতেরোবার এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি শেষে মূল সড়কে পড়া গিয়েছিল।

   তিষ্ঠ ক্ষনকালআচ্ছা ক্ষনকাল মানে ঠিক কতটা কাল? অনেক ভেবে একটা সূত্র আবিষ্কার করা গিয়েছে। ক্ষন-এর দৈর্ঘ্য ইনক্রিজেস উইথ অল্টিটিউড। চা বাগানের পরীদের থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে সবে গিয়েল চা বাগানে প্রবেশ। চোখের সামনেই ঘটল ঘটনাটা। রাস্তা জুড়ে আলাপচারিতায় রত চা সুন্দরীদের ভিড়ে কন্ট্রোল হারিয়ে হঠাত্‌ ধাক্কা এক বাইক আরোহীর। নিজেরও পতন সঙ্গে এক চা সুন্দরীরও পতন। একি সমাপতন! না, কেউ হই হই রই রই করে মারতে গেল না। এক জন আহত চা সুন্দরীর সেবায় নিয়োজিত। বাকিরা পতিত বাইক আরোহীকে উদ্ধারে রত। সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় বোঝানো। রাস্তা জুড়েই। এদিকে গাড়ির সারী। উল্টো দিকেও তাই। মিটিঙ আর শেষ হয় না। দশ মিনিট পার। কারো ভ্রূক্ষেপ নেই কোনো। অবশেষে উল্টোদিকের ট্যাঙ্কার চালক ঘন ঘন শিঙা ফোঁকার পর অবশেষে গতি পায় চাকা।

   কে ঠিক- আবার সেই রোহিনী পথ। সেই আচমকা বাঁক। যথারীতি মুখোমুখি দুই যান। কেউ পিছপা হতে নারাজ। দুদিকে ক্রমে ক্রমে লম্বা হয় সারী। গাড়ির। তবুও অবিচল নিষ্ঠায় নিচের দিকে আসতে থাকা গাড়ির চালক বুঝিয়ে যায় সেই ঠিক। বেশ খানিক পরে যাত্রীরাই উদ্যোগ নেন রাস্তা পরিষ্কার করানোর। কিন্তু কাকস্যপরিবেদনা। দুই চালকের কারোরই ধর্মের কাহিনীতে মতি নেই। শেষে অনেক কাকুতি মিনতির পর প্রায় মিনিট কুড়ি পরে মোহিনের ঘোড়াগুলি, থুরি, পাহাড়ের যানগুলি গতি ফিরে পায়।

   উল্টো পুরাণ- পাহাড়ি রাস্তার আর এক মজাদার দৃশ্য, পাহাড়ি যাত্রীদের উল্টো মতি। যে যাবে যেদিকে সে দাঁড়ায় তার উল্টো পথে। গাড়ি হাত দেখে থামবে। সে ধীরে সুস্থে আসবে। পছন্দের সিট আছে কিনা দেখে তবে উঠবে। না থাকলে ফিরে যাবে নিজের পুরনো জায়গায়। গাড়ি দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তাতে কি? এতো স্বাভাবিক ঘটনা। এমনটা তো হয়েই থাকে।

   গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁরা নিষ্ঠা সহকারে সময় নিয়ে নোট বেছে ভাড়া দিয়ে থাকেন।

   ধর্মের কল, ফাঁকা বোতল- আর একবার। একা সেবার। ফিরছি দার্জিলিঙ থেকে। এনবিএসটিসি-র বাসে। রোহিনীর আগে দশ মিনিটের চা পানের বিরতি। আমার পিছনের সহযাত্রী একটি হাফ লিটারের নরম পানীয়ের বোতল হাতে সওয়ার হলেন। গাড়ি সচল হওয়ার কিছু পরেই সে বোতলের গড়াগড়ি। গাড়ির মেঝেয়। পাহাড়ি বাঁকের নানান প্যাঁচে অবশেষ সে দরজা সংলগ্ন সিঁড়িতে আশ্রয় নিল। শীতের কারনে দরজা বন্ধ থাকায় পরম নিশ্চিন্তে সেখানেই থিতু হলেন বোতল বাবাজী। একবার ভাবলাম তুলে আনি। নামার সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তারপর ভাবলাম থাক। বাস পৌঁছলে সতর্ক করে দেব। তারপর তুলে ট্র্যশ-ক্যানে ফেলে দেব।

   বাস পৌঁছল গন্তব্যে। ভাগ্যের পরিহাস বোতলের প্রাক্তন মালিক সবার আগে দরজার কাছে। আমার মুখে কুলুপ। যা ভেবেছিলাম তাই। বোতলে পা পড়ে বড়সর দুর্ঘটনার হাত থেকে কোনোক্রমে নিস্তার পেলেন প্রাক্তন মালিক।

   – আপনার বোতল আপনার সঙ্গে যেতে চাইছে যে।

   আমার ব্যাঙ্গাত্মক উক্তিতে বাকিরা হেসে উঠলেও ভদ্রলোক মাথা নিচু করে বোতলটি সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন। এবং এটাই ভদ্রলোক লেখার কারন। বেশির ভাগ বীরপুঙ্গব এমতাবস্থায় বোতলের মালিকানা অস্বীকার করে কল্পিত কোনো মালিকের নামে ছাপার অযোগ্য বিশেষণে ভরিয়ে দিতেন। আমার অপরাধ? জেনে বুঝেও ভদ্রলোককে সতর্ক না করা।

   শেষ কাহন- সেদিন দার্জিলিঙ মলে হঠাত্‌ দেখা। (শপিং-এরটা মল হলে দার্জিলিঙ-এরটাও মল। ম্যাল বলতে পারবো না। ক্ষমা করবেন।) আমার এক সময়ের সহকর্মী, ভগিনীসমা। নাম লিখব না। কারন হয়তো আপনাদের পরিচিতা। বিড়ম্বনায় ফেলতে চাইনা। তার পতিদেবটিও আমার একসময়ের সহকর্মী। যাইহোক সকলেই খুশি। দীর্ঘকালের পর আবার দেখা। সঙ্গে তাদের মিষ্টি ছানা। কথায় কথায় বেলা বাড়ে। হঠাত কন্যার খেয়াল হয় ছেলেকে ওষুধ খাওয়াতে হবে। একটি প্লাস্টিকের অ্যাম্পল বের করে মাথাটা ভেঙে ছেলেকে খাইয়ে দেয় ভিতরের ওষুধ। তারপর ক্যাপটা ফেলে দেয় মলের উপর।

   সঙ্গে সঙ্গে পতিদেবের ধমক। কেন এভাবে হিমালয়ের জরা বৃদ্ধি। কন্যাটিও যারপরনাই লজ্জিত। পতিদেব নিচু হয়ে তুলে নেয়। দেখে খুশি হই। ওমা! একি কান্ড! তুলে নিয়ে আবার রাস্তার পাশেই ফেলে দেয় যে। খানিক দূরেই তো গারবেজ ক্যান! এবার আমিই তুলে নিই হাতে। কন্যার স্বগোতক্তি।

   – বাব্বা, রাজাদারও দেখি আমার ভাইয়ের মতন বাতিক। সেতো লজেন্স খেয়ে তার মোড়কটাও পকেটে রাখে। হোটেলে ফিরে ডাস্টবিনে ফেলবে বলে। বাড়াবাড়ির চুড়ান্ত।

   না, মৌন থাকাই সঙ্গত। না হলে এ হঠাত মিলন বিষাদে পরিনত হতে পারে। তবে এ লেখা সেই কন্যে নিশ্চয় পড়বে!

এতদ্বারা সবিনয়ে কহিলা অরিন্দম

পাহাড়ি পথের পাঁচালি হইল সমাপন

%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%a1%e0%a6%bc%e0%a6%bf-%e0%a6%aa%e0%a6%a5%e0%a7%87%e0%a6%b0অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

‘মায়াধারি’ রোয়্যাক

ভ্রমণ সাংবাদিক হিসেবে অনেক জায়গায় গিয়েছি। অনেক জায়গায় ভবিষ্যতেও যাব। সেভেন স্টার হোটেল থেকে হোম-স্টে, থেকেছিও নানান অতিথিনিবাসে। কিন্তু এমন সম্মান কপালে ছিল সেটা ভাবিনি! কোনো এক অতিথিনিবাসের প্রথম অতিথি হওয়ার সুযোগ সত্যিই দুর্লভ। আর সেটাই ঘটে গেল বর্ষণসিক্ত সেপ্টেম্বরের এক শুক্রবারে।

  আগেরদিন, অর্থাত্‌ বৃহস্পতিবার দুপুরে হেল্প ট্যুরিজমের রাজদার হঠাত্‌ ফোন। শিলিগুড়ির অফিসে দেখা করতে হবে তখনি। ভাগ্যিশ তখন শিলিগুড়িতে!

  – কাল সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ো, যদি লেখার রসদ চাও।

  রাজদার সোজা বাউন্সার। বলে কি? পাগলা খাবি নাকি? আঁচাবো কোথায়? আমার বলে সেই দশা, সেখানে জিগ্যেশ করার মানে কি, যে যাব কিনা! যাকে বলে এক পায়ে খাড়া। তবে এবার সফরসঙ্গী রাজদা নয়, হেল্প-এরই, রাজদার সহকর্মী প্রলয়। ছবির দায়িত্বও তার। ব্যাস, আর কি? মন চল নিজ নিকেতনে।

তবে শুক্রবারে যে এমন শনির দশা হবে ভাবিনি। বাড়ি থেকে বেরোতেই অঝোর ধারা। যতই বাঁচাই সেকি আর বাঁচে? তবুও অসীম জেদে পানিট্যাঙ্কি মোড়ে পৌঁছলাম প্রলয়ের আগেই। না, মহাপ্রলয় না এলেও হেল্প ট্যুরিজমের প্রলয় পৌঁছল মিনিট তিনেকের মধ্যেই। কালিম্পঙগামী এনবিএসটিসি-র বাসে উঠে পড়লাম। প্রথম গন্তব্য ৬৩ কিলোমিটার দূরবর্তী তিস্তাবাজার। সেখান সে আছে অপেক্ষা করি তিস্তার তীরে। সে টা কে, সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য।

  জাতীয় সড়ক ১০-এ (পূর্বতন জাতীয় সড়ক ৩১) কালিঝোড়া আর লোহাপুলের ঠিক মাঝামাঝি পৌঁছতেই বাস দাঁড়িয়ে গেল। ন যযৌ, ন তস্থৌ। সারি সারি গাড়ি। এ সহজে নড়বার নয়। অনুসন্ধান করতে হয়। অগত্যা এগারো নম্বর ভরসা। প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ গাড়ির সারিকে অতিক্রম করে আর চড়াই ভেঙে পৌঁছতেই চক্ষু চড়কগাছ। সামনেই নরক গাছ। থুরি, ধসে পাথর আর গাছে রাস্তা বন্ধ। ভাগ্যিশ কোনো গাড়ির উপর পড়েনি, না হলে নরক যাত্রা ছিল অবিস্যম্ভাবী। কারন ভরা বর্ষার তিস্তায় গড়িয়ে পড়লে স্বর্গের এন্ট্রি পাওয়া সহজ হত না, এ হলফ করে বলা যায়। (পথে কোথাও বিউটি পার্লার আছে বলে শুনিনি কখনো)।

  তবে আশার কথা, ইতিমধ্যেই দুটি জেসিবি উদ্ধার কাজে ব্রতি হয়েছে। তবে সাময়িক উদ্ধার মিলল প্রায় ঘন্টা খানেক পড়ে। সাময়িক কেন? পাহাড়ি রাস্তায় (দু লেন বিশিষ্ট) দীর্ঘক্ষণ গাড়ি বন্ধ থাকলে কি নারকীয় পরিস্থিতি হয়, ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। যানজট কাটাতে কাটাতেই পৌঁছে গেলাম তিস্তাবাজার। নির্দিষ্ট সময়ের আড়াই ঘন্টা পরে।

  দেখা মিলল ‘সে’-র। নগেন গুরুং। অতিথিকে রিসিভ করতে ২০ কিমি পাহাড়ি পথ বেয়ে নিজেই এসেছেন গাড়ি চালিয়ে। হ্যাঁ, এনার অতিথি নিবাসেই রাত্রীযাপন যাত্রীদ্বয়ের। তবে আরও মহত্‌ উদ্দেশ্য ছিল, প্রকাশিত হল ক্রমে ক্রমে। পেটে উপস্থিত গণেশবাবার বাহনের ক্ষুধা মেটানো হল চিকেন মোমো সহযোগে। তারপর? ত্রিবেণী। আরে ধুর মশাই, হুগলির ম্যাপ খুলছেন কেন? তিস্তাবাজারের অনতিদূরেই এই ত্রিবেণীর অবস্থান। যেখানে বর্ষায় মত্ত রঙ্গিত তার পৌরুষের আস্ফালনে সঙ্গমে রত এক মত্ত নারী তিস্তার সঙ্গে।

  একাধিকবার পেলিং যাওয়ার পথে, রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে যে শপথ নিয়েছি নিজেই নিজের কাছে, তার এমন ‘কাকেদের দেখিয়ে দেখিয়ে পরীদের বেদানা খাওয়ার’ (কাকস্যপরিবেদনা) দশা হবে ভাবিনি কোনোদিন। তিস্তা-রঙ্গিতের সঙ্গমের সংযোগস্থলে অবস্থিত ছবির মতন বাঙলোয় এক রাত নিজেকে সময় দেবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হল অবশেষে। ডিজিএইচসি-র আমলে ছবির মতন বাঙলোটি বিশেষ অতিথিদের জন্য নির্মিত হলেও আজ তা পুলিশের ব্যারাক। অতিথি প্রবেশ? নৈব নৈব চ। কি অত্যাচার!। তবে, অত্যাচারিত হতে দিল না কামে মত্ত দুই নদী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন আগল দিল ফুসফুসে। ইংরেজি বললে সুবিধে হয়? ব্রেথটেকিং।

  চাকা গড়ায়। পরবর্তী গন্তব্য জানা নেই। কাণ্ডারীর ভুমিকায় খোদ গুরুং দাজু, পথিকের ভাবনা কি! এক ঝটকায় সাড়ে তিন পাক। পাহাড়ি loop-এলু রাস্তায় পেশক চা বাগানের প্রসারিত আঁচলে। সাগর তট থেকে প্রায় হাজার দুয়েক ফিট উচ্চতায় রুদ্ধ হল গতি। কি জ্বালা! প্রিয়া বিনা এ কেমন মতি! এসেছি যে লাভার্স পয়েন্টে। হায়, অনামিকা, তুমি এখন কংক্রিটের জঙ্গলে কর্পোরেট সুনামিতে ধ্বস্ত। তোমা বিনে এ সৌন্দর্য বড়ই বিষাদগ্রস্থ! নিচে প্রেমিকযুগল রঙ্গীত আর তিস্তার প্রেমের এমন মনোহর টপ ভিউ কি আর একা ভাল লাগে? উপায় কি? তাই মনে মনেই হাত রাখি তোমার হাতে। এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস পরশ দিয়ে যায় শরীরে। সারাদিনের ভোগান্তি যেন নিমেষে উধাও।

  থামার উপায় নেই বেশিক্ষণ। তাই চরৈবেতি, চরৈবেতি। পথের পাকে পাকে শুধু বেড়ে চলে উচ্চতা। আর উচ্চতার সাথে সাথে পোষাক বদলায় প্রকৃতি। লোপচু বাজার পার হতেই মেঘের মেখলায় মায়াবিনী, মুখ্যমন্ত্রীর মানসকন্যা লামাহাটা। যেখানে পাইনের হাত ধরাধরি। আয় তবে সহচরি-মেজাজে। পাইনের ফাঁকে ফাঁকে পাথর বিছনো পাকদণ্ডি। ডাক শুনে যখন কেউ আসেনি তখন একলা চলতেই শিখিয়েছেন কবি। তাই পাইনের সাথে মিতালি পাতিয়ে পা ফেলি উপর পানে। ঠিক যখন ফুসফুস জবাব দেবে কিনা ভাবছে তখনই পৌঁছলাম ছোট্ট লেকের পাড়ে। পর্যটন দপ্তর ভারী সুন্দর সাজিয়েছে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সে সজ্জার রূপে নাকি চোখ ফেরানো দায়। কিন্তু কাজল কালো বাদল ঘেরা অপরাহ্নে এ যেন প্রাকৃতিক ইন্দ্রজাল। লেকের সাথে জলকেলি মেঘেদের। যার সাক্ষী লাজে নত পাইনের দল আর নির্লজ্জ এক পথিক। কবি হতে চাওয়া গুটিপোকাদের প্রজাপতি হয়ে ওঠা শুধু পৌঁছনোর অপেক্ষা।

  খানিক একলা যাপন, তারপর ফেরার পালা। নিজেকে আবার প্রতিশ্রুতি দিলাম, পরেরবার এক রাত তোমার সঙ্গে, লামাহাটা। শুধু তুমি আর আমি। নিচের সুন্দর সাজানো বাগানে খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার চলা। এবার সরারসরি গুরুং দাজুর ডেরায়। পাকস্থলী জবাব দেওয়ার বাহানা খুঁজছে। কিন্তু প্রকৃতির যে অন্য ইচ্ছে। যে লোপচু বাজার পার হয়ে এসেছি ঘন্টা খানেক আগেই, সেখানেই হঠাত্‌ ধরাশায়ী দশাসই এক বৃক্ষ। খণ্ডিত না করলে পথ মিলবে না। স্থানীয়রাই কুড়ুল করাত নিয়ে আমাদের পোড়া বরাতকে শুধরোতে নেমে পড়লেন কোমড় বেঁধে। বর্ষণসিক্ত দ্বিপ্রহরে অনেক কর্ষন আর ঘর্ষণের পর প্রশস্ত হল পথ।

  – এবার যাত্রা কোন চুলোয়?

  খেঁকিয়ে ওঠে পাকস্থলি। জঠরে যে তখন চুলোর আগুন লেলিহান।

  – তিন চুলোয় রে বাবা তিন চুলোয়।

  সান্তনা দিই তাকে। মানেগত সাদৃশ্য থাকলেও উচ্চারণগত ভাবে সামান্য প্রভেদ আছে আমাদের গন্তব্যের নামে। আমরা যাচ্ছি তিনচুলে। চুলো বা চুল্লি সদৃশ্য তিনটি পাহাড় চুড়োর অবস্থান-ই এ জায়গার এহেন নামকরনের কারন।

  তবে তিনচুলে কিন্তু ভারতের পর্যটনের ইতিহাসে একটি উজ্বল মাইলফলক। ফেরতযোগ্য শর্তে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড বা ডাব্লিউ ডাব্লিউ এফ-এর রাজ্যশাখা টাকা দিয়েছিল স্যানিটারি টয়লেট নির্মানের জন্য। সেটাকে সামনে রেখেই ১৯৯৩ সালে পরীক্ষামূলক কাজ শুরু হয় হেল্প ট্যুরিজমের নেতৃত্বে। তৈরি হয় দেশের প্রথম হোম-স্টে ট্যুরিজম। যদিও চালু হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। গুরুং কটেজ, সাংমো নিবাস আর ভুজল নিবাস প্রথম সূচনা করে এক ঐতিহাসিক যাত্রাপথের। গুরুংদের পারিবারিক যৌথ উদ্যোগে যে পালে হাওয়া লাগতে সময় লাগেনি মোটেই।

  আজ ঠিক কুড়ি বছর পর তিনচুলের উপকন্ঠে সেই গুরুং ভাইদেরই একজন নিজের উদ্যোগে বানিয়েছেন তিনচুলে হোম-স্টে। মায়াধারি জঙ্গলের রোয়্যাক বনবস্তি সংলগ্ন এই ছবির মতন হোম-স্টে দেখে আর থেকে মন ভরে গেল। বাড়ির বারান্দায় দাঁড়ালে সামনে সারি সারি শ্বেতটুপি পরিহিত উদ্ধত শৃঙ্গের দল। যে দলে একাধারে ফার্স্ট বয় এভারেস্ট তথা থার্ড বয় কাঞ্চনজঙ্ঘার উজ্বল উপস্থিতি।

  নগেন দাজু সঙ্গে ছিলেন, আপ্যায়নের দায়িত্বে তাই গুরুংগৃহিনী সুমিত্রা ভাবি। বিকেল চারটেয় কি মধ্যাহ্নভোজন বলা যায়? কিন্তু গুরুং-ডেরার গুরুভোজনের ঠেলায় কাত দুই যাত্রী। বৌদির স্বহস্তে রান্না করা পঞ্চব্যাঞ্জনের ব্যাঞ্জনায় আইঢাই। ঘী দিয়ে শুরু, ডাল আর নানান তরকারি সহযোগে মাছ এবং মাংসের উপস্থিতির শেষ তেঁতুলের চাটনিতে। পরিবেশনে মমতময়ী গুরুং বৌদি স্বয়ং।

  কথায় কথায় তিনচুলের নামকরণের তিনকাহন বেরিয়ে এলো। একটি আগেই বলেছি। তিনচুলের তিনটি পাহাড়কে ত্রিদেব হিসেবেও মান্যতা দেয় স্থানীয় মানুষ। তবে তিন নম্বর কাহিনীটি অভিনব। বনবাসকালে রাম-সীতা নাকি এখানেও ডেরা বেঁধেছিলেন! তখন ঐ তিন-পাহাড়ি চুলোয় নাকি প্রস্তুত হত তাদের আহার্য! (প্রশ্ন হচ্ছে যিনি রাঁধতেন তাকে অন্তত ২৫ ফুট লম্বা হতে হয়! আর রন্ধন-পাত্রের মাপ হতে হয় ছোটোখাটো ফুটবল মাঠের সমান!)। প্রশ্ন করতেই পারেন, কিন্তু উত্তর মেলার গ্যারান্টি নেই।

  পেটের বিদ্রোহ দমন করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল প্রস্তরহস্তি দর্শনে। না, অন্ধের নয়, চক্ষুস্মানের হস্তি দর্শন। জায়গাটির নাম মূলাফটক। একটি বিশালাকায় প্রস্তরখন্ড। যার সম্মুখের অংশ প্রাকৃতিক ভাবেই হাতির মাথা আর শুঁড়ের সঙ্গে সাদৃশ্য বহন করে। ব্যাস, আর যায় কোথায়। দেবত্ব আরোপে সময় লাগেনি মোটেই। এখন সেটি গণেশ রূপে পুজিত। সাম্প্রতিক গণেশ-চতুর্থী উত্‌সবের সাক্ষ্য চারিদিকে। ফেরার পথে দর্শন হল তিনচুলে মনাস্ট্রির। সেই তিনটি পাহাড়ের একটির উপর এই গুম্ফার অবস্থান। তিব্বতীয়-বৌদ্ধধর্মের নিংমা শাখার গুম্ফা এটি। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জাটাল সাঙ্গে দোর্জে।

  পরদিন ভোর থেকেই মেঘেদের লুকোচুরি। তার মাঝেই বোধহয় দয়াপরবশ হয়ে (নাকি অবিশ্বাসীর মুখ বন্ধ করতে?) মিনিট দুয়েকের ঝাঁকিদর্শন দিলেন কাঞ্চনজঙ্ঘা। ব্যাস। কিন্তু মন কেড়ে নিল আমাদের বাসস্থান সংলগ্ন পাইনের জঙ্গল। স্থানীয় এক রানীসাহেবা এ জঙ্গলকে বড়ই ভালবাসতেন। তাঁর ভালবাসার বন্ধনের স্বীকৃতিতেই নেপালি ভাষায় নামকরন, ‘মায়াধারি’।

  গরম গরম লুচি আর আলুর সব্জি সহযোগে উপবাসভঙ্গের (ব্রেকফাস্ট) পর আমাদের যাত্রা হল শুরু। সাইট সিইং। তবে গুরুং দাজু আজ অন্য কাজে ব্যাস্ত। তাই সারথী তথা পথপ্রদর্শকের ভুমিকায় ইস্মল। নায়কোচিত চেহারা আর এলাকায় বিপুল জনপ্রিয়তা। টের পেয়েছিলাম সারা দিন ধরেই।

  তাগদা বাজার ছাড়িয়ে ব্রিটিশ নির্মিত তাগদা ক্যান্টনমেন্টের কাছে এসে থামলাম। উদ্দেশ্য তাগদা অর্কিড নার্সারি দর্শন। ব্রিটিশদের আর এক কীর্তি। যা এক সময় ছিল দেশের বৃহত্তম নার্সারি। দুষ্প্রাপ্য অর্কিডদের আঁতুরঘর। তারপর পাহাড়ের অশান্ত সময়ে নেহাতই শান্তশিষ্ট অর্কিডদের উপর হামলা চলে। গৌরবের তাজ তারপরেই ধুলিমলিন। এখনও যা বেঁচে আছে, অর্কিডপ্রেমী হলে তাও কয়েক ঘন্টা সময় কেড়ে নেবে। এই বিশাল বাগানে এখনও ৪২ প্রজাতির ওষধি গাছ আর ৪৫ রকমের অর্কিডের উপস্থিতি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল স্নো-গার্ল, কোমোয়াতো ইয়ালো বার্ডস, কনিউজিন কালার, জেল কার্গ, ওর্কে পিঙ্ক, গোল্ডেন গার্ল প্রভৃতি।

  ইচ্ছে না থাকলেও সময়ের অভাবে রওনা দিতেই হয়। এবার শুধু নিচের পানে যাত্রা। পথে পার হলাম দুটি চা-বাগান। রংলি-রংলিয়ট আর পুবং। অবশ্য তৃতীয় আর একটির আলিঙ্গন একটুর জন্য এড়িয়েছি। তখন কি জানি তাকে পার করাতেই আমাদের ভবিষ্যত্‌ ভাগ্যলিখন।

  পুবং পেরতেই হঠাত্‌ পথ শেষ! না, আছে। পথ আছে। তবে সে প্রস্তর নির্মিত প্রাচীন প্রশস্ত পায়ে চলা পথ। গাড়ির পথ নেই। খানিকটা নামতেই ঝুলন্ত সেতু। হয়তো সিংশোর ব্রিজের কৌলিন্য নেই কিন্তু ঐতিহ্য আর আগলে রাখা বন্য প্রকৃতি এই সেতুকে দিয়েছে অন্য মাত্রা। ব্রিজের মাথায় ছোট্ট ধাতব ফলক। সামান্য কয়েকটি কথা লেখা। কিন্তু তাই যেন খুলে দিল ইতিহাস বই-এর পাতা। সেতুর নির্মাতা বিলেতের বিখ্যাত জর্জ ক্র্যাডক কোম্পানি লিমিটেড। বয়স পাক্কা একশো। (১৯১৬ সালে নির্মিত)। কিন্তু ভারবহনে কতটা সক্ষম সে সংক্রান্ত তথ্যই আসলে উল্টে দিল ইতিহাসের পাতা। Weight Limit- Not more than 10 loaded ponies! বোঝো কান্ড! তার মানে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে নিয়মিত পণ্য যেত। নাকি আসতো? দ্বিতীয়টাই ঠিক। ১৯১১ সালে তাগদায় ক্যন্টনমেন্ট স্থাপন করা হয়। আসা যাওয়া ছিল দার্জিলিং ঘুরে। কিন্তু সে বড় ঘুর পথ। তাহলে পণ্যর জন্য দরকার শর্টকাট। আর সেই রাস্তা ছিল এটা! তার মানে আমরা যে পথে এসেছি তিনচুলে, সে পথের থেকেও এ পথে গাড়ি চললে রাস্তা কম হবে। তখনই চোখে পড়ল যান চলাচলের জন্য সেতু নির্মাণ হচ্ছে পাশেই। দুটো প্রশ্ন জাগল মাথায়। প্রথমত সেতু নির্মাণ শেষ হলে এই ঐতিহাসিক সেতুর ভবিষ্যত্‌ কী? আর যে শর্টকাট রাস্তাটা ব্রিটিশরা চিনেছিল ১০০ বছর আগে সেই রাস্তাকে যান চলাচলের উপযোগী করার চিন্তা স্বাধীন ভারতে সরকারের মাথায় আসতে প্রায় ৭০ বছর লেগে গেল! আমরা তিনচুলে উঠেছি তিস্তা বাজার পার করে। তার থেকে একটু কম হয় তিস্তাবাজার, বড় মাঙ্গোয়া, সোরেঙ হয়ে এলে। কিন্তু সে রাস্তার অবস্থা এতটাই বেহাল যে পোস্টার বানিয়ে লেখা প্রয়োজন, ইহা এক কালে রাস্তা ছিল। আর একটি যান চলাচলের পথ আছে তাগদা থেকে যে পথে খানিকটা আমরা এসেছি, তারপর গিয়েল আর তিস্তা ভ্যালি চা বাগানের মধ্যে দিয়ে রম্ভি বাজারের একটু আগে জাতীয় সড়ক ১০। এ পথ আরও কম। বানিজ্যিক গাড়ি এ পথেই চলে। কিন্তু রাস্তা খুব ভাল নয়। এই সেতুটি নির্মান হলে সরাসরি লোহাপুলে নামা যাবে। মানে আরও প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তা কমবে।

  পরের গন্তব্য গিয়েল চা বাগান পেরিয়ে তিস্তা ভ্যালি চা বাগানের সর্ব্বোচ্চ পয়েন্ট। দূরপিন দাঁড়া। দূরবীক্ষণ অর্থেই দূরবীন বা দূরপিন। যেখান থেকে অনেক দূর দেখা যায়। তবে খালি চোখেই। কালিম্পঙেও আছে এমন ভিউ পয়েন্ট। এখানে প্রায় সাড়ে চার হাজার ফিট উচ্চতা। গাড়ি না নৌকা এই কনফিউশনের ইতি হল গন্তব্যে পৌঁছে। এবার সত্যিই দমবন্ধ অবস্থা। রাস্তার ক্লান্তি নিমেষে উধাও। আহা কি দেখিলাম! রম্ভি থেকে তিস্তার মর্ত্যে আগমণ। প্রায় ২০ কিলোমিটার যাত্রাপথ, একসঙ্গে চোখের সামনে। কোন পাহাড়কে কতটা বের দিয়েছে, কোথায় কারা এসে ঝাঁপিয়েছে বুকে, সব নক্সা নিমেষে উন্মোচিত। গুগল আর্থ দেখছি, এ বিভ্রম হতেই পারে। রমণীয় সুখের সাথে তুলনা করাই যায়। তিস্তাও তো রমণী। সময় থমকে যায়। বেপরোয়া আমরাও সময়কে চোখ রাঙাই। হয়তো তারও লজ্জা হয়।

  আবার গুরুং গৃহে গুরু ভোজনং। তবে সময়টা দ্বিপ্রহর হওয়ায় রসনার পরিতৃপ্তি। আধ ঘন্টা গড়িয়ে নেওয়া। তারপর আবার পথে এবার নামো সাথী। এবার পূর্বে বর্ণিত এক কালে পথ ছিল পথে, যাত্রা ইস্মলের রথে। তবে খেল দেখালো ইস্মল। মেঘের চাদরের আদরে তখন দমবন্ধ অবস্থা। দশ হাত দূরে শুধুই সাদা। প্রতি মুহুর্তে নিজেকে বলি, পতন অনিবার্য হাঁদা। আমার মনকে টোন কেটে অসাধারন দক্ষতায় পথ খুঁজে নেয় ইস্মল। সোরেঙ পার হয়ে পৌঁছই তাকলিন।

  ১০৫ বছরের পুরনো তাকলিন গুম্ফা দর্শনে। এটিও নিংমাদের। মনস্কামনা পুরনে এখানে যথেচ্ছ প্রেয়ার হুইল ঘোরানোর অবকাশ আছে। প্রাচীন গুম্ফা তার প্রাচীনত্ব বজায় রেখে গাম্ভীর্যে অটল। সচল শুধু ক্যামেরার শাটার। সঙ্গে বাতাসের স্পর্শে ধর্মীয় নিশানের আন্দোলিত আওয়াজ। মনটা হঠাত্‌ শান্ত হয়ে গেল। গুম্ফার দুটি তলই ঘুরে ঘুরে দেখা হল। জ্বালানো হল ধূপদানীতে ধূপ। সামনেই গুরু পদ্মাসম্ভবার ধ্যানস্থ রূপ। আর তিব্বত থেকে আনা শতাব্দী প্রাচীন পুঁথির স্তূপ। দেওয়ালের ম্যুরালে বৌদ্ধ ধর্মীয় উপকথার চিত্ররূপ। সে বর্ণনা দেওয়ার থেকে চাক্ষুস করাই যুক্তিযুক্ত।

  জানা গেল এক অলৌকিক কাহিনীর কথা। বছর বারো আগে। ২০০৪-এর সকাল। নিয়মানুসারে নিত্য-প্রার্থনা সারা। পুরোহিত গুম্ফার দুই তলেই তালা এঁটে নিজগৃহে। হঠাত্‌ শিঙার আওয়াজ। উত্‌স মন্দিরের একতলা। সঙ্গে সঙ্গে চাবি খোলা। কি আশ্চর্য! নেই কোথাও কেউ। আবার শিঙা ফোঁকার ঢেউ। এবার আওয়াজ আসে দ্বিতল থেকে। সকলেই উপরে ওঠেন নিচে একজনকে পাহারায় রেখে। আবার খোলা হল তালা। কিন্তু একি জ্বালা! দ্বিতলও তো ফাঁকা। শিঙাগুলিও যথাস্থানে রাখা। ভক্তিতে পুরোহিতের চোখে বারি। প্রভু তুমি তবে নিজেই বংশীধারী (শিঙা)!

  বড়মাঙ্গোয়া। মাঙ্গোয়া অর্থাত্‌ পোদো ক্ষেত। আসলে মিলেটস। সিকিমিসরা যাকে ছাং বলে। যা থেকে তৈরি হয় অর্গানিক বিয়ার। ছোটোমাঙ্গোয়াও আছে। তবে তার উচ্চতা অনেক বেশি। আমাদের এবারের গন্তব্যের তালিকায় রাখা যায়নি। হাজির হলাম গ্রিনলন কটেজে। এও হোম-স্টে। কিন্তু এখানে আনার উদ্দেশ, কমলা বাগান দর্শন। মহা মুশকিল। কমলা বাগান দেখার কি আছে! মিনিট দশেকের মধ্যেই গালে যে নিঃশব্দ চড় পড়বে জানা ছিল না। আমাদের আপ্যায়িত করতে হাজির হলেন বৃদ্ধ গৃহকর্তা স্বয়ং। ছোট্টখাট্টো চেহারার সদা হাস্যময় বৃদ্ধকে দেখে বিরক্তিটা কমলো। তখনও চমক ছিল বাকি। আরে এখানেও নামেতে ফাঁকি। যাকে বলে পদ্মলোচন কেস। এই হাসিখুশি বৃদ্ধ নগেন সিং গুরুং-এর সহোদর। নাম? গম্ভীর সিং গুরুং। কি আপদ! চিরটাকালই কি এই হবে! ততক্ষণে আমি তথ্যে সুনামিগ্রস্থ। অর্থাত্‌ চড়টা গালে পড়েছে। ভদ্রলোক যেন চলতা ফিরতা এনসাইক্লোপিডিয়া। (বয়স জনিত প্রাচীনত্বের কারনে উইকিপিডিয়া নামটা দিলাম না)।

  সাড়ে তিন একর বিস্তৃত এই বাগান। গড় উচ্চতা ২৮০০ ফিট। এখানকার মাটিতে যা সয়, এই বাগানে তাই হয়। হয় না শুধু গোলমরীচ। ফল, সব্জী, মশলা, ডেকোরেটিভ প্লানটেশনস সব। খালি নাম বলুন। ও ওষধি গাছও। না, না, শুধু মুখে নয়, নিজে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। প্রতিটা গাছ চেনালেন। আর বৈজ্ঞানিক নাম, তার জ্ঞাতিগুষ্ঠির বিবরন শুনে আমার সাংবাদিক মন আমায় শেখালো এই জায়াগা বোটানির ছাত্র-ছাত্রীদের উপযুক্ত প্র্যাকটিকাল ক্লাসের জায়গা। খালি হেল্প ট্যুরিজমের সঙ্গে যোগাযোগের অপেক্ষা। সে বিবরনও লেখার শেষে পাবেন।

  আপনারা নিশ্চয় জানেন, কিন্তু আমার মতন গণ্ডমুর্খ সাংবাদিক এখানে গম্ভীর দাজুর কাছে শিখলাম কমলালেবু মানে অরেঞ্জ নয়। ম্যান্ডারিন। অনেক ভ্যারাইটির মধ্যে যে দুটো আমরা সব থেকে বেশি খাই, সে দুটি হল দার্জিলিং ম্যান্ডারিন (হ্যাঁ, কালিম্পঙেরটাও) আর নাগপুর ম্যান্ডারিন। তাহলে অরেঞ্জ কোনটা? মুসুম্বি লেবু। তফাত? গাছে থাকা অবস্থায় তফাত করা একটু কঠিন। বেসিক তফাত হল ম্যান্ডারিনের চামড়া আলগা তাই আঙুল দিয়েই ছাড়ানো যায়। অরেঞ্জে বা মুসুম্বির ক্ষেত্রে যে ছুঁড়ি বা বঁটি লাগে এটাতো জানাই। কারি পাতা খান তো? জানা আছে কি যে পরিবারগত ভাবে এরা অরেঞ্জ বা ম্যান্ডারিনের কাজিন ব্রাদার! যাকে বলে ঘেঁটে লাট। তরকারিতে কারি পাতা দিলে এর ওষধিগুণ হারিয়ে যায়। কিন্তু এটা ডায়াবিটিসের জন্য খুবই উপকারি!

  তেজপাতা, লবঙ্গ, বড় আর ছোটো এলাচ, দারুচিনি, বাতাবি, ন্যাসপাতি, কফি, চাইনিজ টি, অ্যাসপারাগাস, ডুমুর (কি সাইজ!), কৃমি মারার জন্য সাইট্রন, অ্যান্টি ক্যানসার ভেষজ……প্রকাশক এবার আমায় মারবে। এত লিখলে পাতা কখন ছাড়বে? খালি দুটি সংযোজন। এক, সাধুরা রুদ্রাক্ষের মালা পড়েন কারন এটা হাইপারটেনসন কমায় (সে গাছও আছে)। দুই, এখানে উত্‌পাদিত বেশিরভাগ জিনিষ এখানেই প্রসেসড হয়, এবং কেনার জন্য কাউন্টারও আছে।

  উফফফফফফফবাপরে।

  যোগাযোগহেল্প ট্যুরিজম। ফোন৯৭৩৩০০০৪৪২৪৪৭। মেল– info@helptourism.com

  আর এনজেপি পৌঁছনোর ট্রেনের খবর বা বাগডোগরার ফ্লাইটের টাইম টোবল নিশ্চয় আমায় বলে দিতে হবে না। বরং জনান্তিকে বলি, দরকারে আমি আপনাদের সাহায্য চাইতে পারি।

লাল বালি নীল জল

বালির দেশে প্রথম বালি দর্শন। পেট্রার মায়া ভুলিয়ে ১২১ কিমি যাত্রা। মধ্যাহ্ণ আহার সমাপিত পেট্রাতেই। তাই দীর্ঘ যাত্রাপথে বাঙালি চোখে ভাতঘুমের আবেশ। সমঝেই আব্দুলের সমঝদারি। একটু এলাচ কফির বিরতি। গাড়ি থেকে নামতেই সাপটে ধরে হিহি কাঁপুনি হাওয়া। গরম কফিতেই তৃপ্তি পাওয়া। মরুর দেশে পথের দুধারে লালচে ধূসরের যুগলবন্দিতে ইতিউতি সবুজের থাবা। জানা যায় ফসল ফলেছে। টোম্যাটো আর তরমুজ। তবে তাদের স্থায়িত্ব ছিল খুবই কম। একটু একটু করে জাপটে ধরে বালি। গাড়িতে ভারতীয় সাংবাদিকদের চোখে মরু দর্শনের উত্তেজনা।

  এই মরুভূমির প্রতিটি বালুকণা সাক্ষী আরব দুনিয়ার স্বাধীনতার ইতিহাসের। ১৯১৬ – ১৯১৮। দ্য গ্রেট আরব রিভোল্ট। ওটোমান তুর্কদের হাত থেকে জোটবদ্ধ আরবদের স্বাধীনতার যুদ্ধ। নেতৃত্বে শরীফ হাসেম বিন-আলি। পশ্চিমি দুনিয়া অবশ্য তার কৃতিত্ব দিতে চায় ব্রিটিস লেফ্টানেন্ট টি. লরেন্সকে। পাঠকদের নিশ্চিত স্মরনে আছে পিটার ও’টুলে অভিনীত ক্লাসিক, লরেন্স অফ আরাবিয়া ছবিটির কথা। এতেই আরব দুনিয়ার একাংশ ক্ষুব্ধ। প্রথমত আরবদের লড়াইকে নাকি খানিকটা খাটো করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত ব্রিটিশদের সহায়তা লাভের দাম দিতে হয়েছে জর্ডনকে তাদের উপনিবেশে পরিনত হয়ে। যার হাত থেকে মুক্তি পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৪৬ এর ২৫শে মে পর্যন্ত। শরীফের পুত্র প্রথম আব্দুল্লার নেতৃত্বে স্বাধীন হয় জর্ডন। নাম হয় হাসেমাইট কিংডম অফ জর্ডন।

   চারিদিকে ছোটো ছোটো বেলে পাথরের টিলা। বাকিটা শুধুই বালি। সেরকমই এক ছোটো টিলার সামনে থামলো গাড়ি। সামনে বেদুইন তাঁবুর সারি। আপাতত এখানেই আতিথ্য বরণ। ছোটোবেলা থেকে মনের মধ্যে লালিত বোহেমিয়ান ভাবনার হঠাত বাস্তবায়ন। …”আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস। আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ”…। আল্লা হাইহুম ধ্বনিতে আপ্যায়িত হয়ে মনের ইচ্ছে পূরনে মিলেছে বেদুইন পোষাকে সজ্জিত হওয়ার সুযোগ। সঙ্গে পিতৃদত্ত নামের বদলে নতুন নাম শেখ আফজল। নামকরণ সৌজন্যে আব্দুল, পোষাক সৌজন্যে বেদুইন দলপতি মহম্মদ ভাই।

   এই মরু শুধু ইতিহাসের নয় সাক্ষ বহন করছে অনেক হলিউড ব্লকবাস্টার্স নির্মাণেরও। একটি ছবির নাম আগেই বলেছি, এছাড়াও আছে ট্রান্সপোর্টার টু, ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড হিস লাস্ট ক্রুসেড আছে চাঁদের উপর নির্মিত বিশ্বখ্যাত একটি তথ্যচিত্রও। আরে মরুভূমির নামটাই তো বলা হয়নি ! ওয়াদি রাম। ওয়াদি মানে উপত্যকা রাম মানে উঁচু। তাছাড়াও এই মরুকে দ্য মুন ভ্যালি নামেও ডাকা হয়। চাঁদের উপর তথ্যচিত্র নির্মাণের রহস্যটা পরিষ্কার হয় এবার।

  বেদুইন পোষাকে সজ্জিত হয়েই মরুভূমির আরও গভীরে প্রবেশ। না উটের সওয়ারিটা হয়নি, সময় কম থাকায় তার বদলে খোলা জিপ গাড়িই ভরসা। সূর্যাস্ত দেখার পালা। একটি টিলায় পর্বতারোহীদের ঢঙেই টিলারোহন (দড়ি বা বরফ কুঠার প্রয়োজন হয়নি এই যা)। মহিলা সহকর্ম্মীদের জন্য আব্দুল একাই একশো। জর্ডন আসা ইস্তক সিভ্যালরির ছটাকমাত্র সুযোগ হাতছাড়া করেনি আব্দুল। এ ব্যাপারে তার ভূল হয়নিকো বিলকুল। (পাঠকরা যদি পোড়া গন্ধ পান আমি ক্ষমাপ্রার্থী)। অবশেষে শৃঙ্গজয় এবং প্রতীক্ষা।

   উপর থেকে যতদূর চোখ যায় মায়াবী ওয়াদি রাম। বালির সমুদ্রে দূরে একঝাঁক মরুজাহাজ। তাড়া নেই কোনো। দুলকি চলনে তাঁবুমুখি। সুয্যিমামার পাটে বসার যোগাড় যন্তর সারা। নামলেই হয়। শুরু হল মায়াবী আলোর খেলা। যা শুধু প্রকৃতি দেবীই খেলতে পারেন। হলুদ, কমলা, লাল আর বেগুনির মিশ্রনে অনন্য সাধারন রঙ্গোলি। বালির সিলিকন কণার বিচ্ছুরনে স্পেসাল এফেক্টের মাধূর্য। টিলার ছায়াদের দৌড় প্রতিযোগিতা। কে আগে বাড়তে পারে। কয়েকটি বাকরহিত মুহুর্ত। ব্যাস, খেলা শেষ। দ্য শো ইজ ওভার। আকাশের গায়ে তখন এক্কাদোক্কা তারাদের আগমণি। হঠাত হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে ঠান্ডা জানান দিল, এ মরভূমি বস। পাঙ্গা নিওনা। সকলেই কাঁপতে কাঁপতে তাঁবুতে ফিরতে ব্যাস্ত।

  তাঁবুতে ফিরে কফি সহযোগে আপ্যায়িত হয়েই আবার যাত্রা করতে হবে। কঠোর নির্দেশ আব্দুলের। অগত্যা। যদিও পর্যটকদের জন্য থাকার দিব্য ব্যবস্থা আছে। সুসজ্জিত কামরা আর ততধিক সুন্দর বিছানা। কিন্তু সরকার তার অতিথিদের মরুভূমিতে ফেলে রাখতে মোটেই রাজী নন, থাকতে হবে কোনো এক পাঁচ তারাতেই, তাই এখানে থাকার অনুমতি মেলে নি ! গৃহকর্তা (নাকি তাঁবুকর্তা !) মহম্মদ ভাইয়ের নির্দেশে কফি আসে। কিন্তু এ আবার কী! অতিথিদের না দিয়ে শুধুমাত্র মহম্মদ ভাইকেই কফি পরিবেশন করা হল ! আর তিনিও দিব্য তৃপ্তিতে মৌতাতে সে কফিতে চুমুক দিতে লাগলেন। সাংবাদিককূল দিশাহরা। খালি পরস্পরের দিকে চোরা দৃষ্টি নিক্ষেপ। মহম্মদ ভাইয়ের কফিপান শেষ হওয়ার পর পাত্র থেকে অতিতিদের পেয়ালায় পরিবেশিত হল কফি। সকলের বিহ্বল দশা দেখে আসরে অবতীর্ণ হয় আব্দুল। শোনায় এক চমকপ্রদ কাহিনী।

  বেদুইনরা বরাবরই ভবঘুরে শ্রেণীর মানুষ। তবে জিপসিদের মতন নয়। অনেকবেশি অবস্থাপন্ন। ভবঘুরে হলেও প্রতিটি গোষ্ঠির আছে নিজস্ব এলাকা, নিজস্ব সম্পদ। একসময় বেদুইনদের গোষ্ঠিদ্বন্দ ছিল চরমে। নেতৃত্ব বা সম্পত্তি হাতানোর জন্য নানান কলাকৌশলে একে অপরকে হত্যা করা ছিল জলভাত। সেই হত্যা করার একটি পরিচিত কৌশল ছিল বন্ধুবেশে শত্রুকে নিজের তাঁবুতে আপ্যায়ন করে বিষমিশ্রিত কফি পান করিয়ে হত্যা করা। এরপরেই পরস্পরের মনে বিশ্বাস উদ্রেক করতে রীতি হয় অতিথির সম্মুখে আগে কর্তা নিজে কফি পান করবেন তারপর সেই একই পাত্র থেকে অতিথিকে পরিবেশন করা হবে কফি। প্রমাণ করতে কফিতে বিষ মেশানো নেই। সেই থেকে বেদুইনি আতিথেয়তায় এ রীতিই নিয়ম হয়ে গেছে। যদিও এখন আর সেরকম পরিস্থিতি নেই। বেদুইনরা অনেক শান্তিপ্রিয় এবং আইন মেনে চলেন। কিন্তু রীতি রয়ে গেছে একই। তাই মহম্মদ ভাই আমাদের সামনেই আগে কফি পান করেছেন। আমাদের অসম্মান করার জন্য নয় বরং চরম সম্মান প্রদর্শনই করেছেন।

  এলাচ কফি, আড্ডা, ফোটোসেশনতাঁবুর বাইরে ঝিকিয়ে ওঠা বাঁকা চাঁদ নিশিরাতের আকাশে, সঙ্গে তাঁবুর ইতি উতি আলো। আমাদের এক চিত্রসাংবাদিক বন্ধু মৃণাল মনের মতন সাবজেক্ট পেয়ে ফোটো তোলায় মসগুল। কিন্তু আব্দুলের চোখ ঘড়ির দিকে। তার চিত্কারে সবাই মায়াময়তা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ‘হোয়্যার ইজ মিরররনাল? ইয়াল্লা, ইয়াল্লা (তাড়াতাড়ি)’। আব্দুলের ইয়াল্লা ইয়াল্লার ঠেলায় আবার সচল গাড়ি। লালচে বালুকাভূমি ছেড়ে গন্তব্য লালচে জলের রাজত্ব । কোনো দ্বর্থক ইশারা নেই, এবার ঠিকানা যে লোহিত সাগর।

  আকাবার পাঁচতারায় বাকিদের ঠাঁই তৃতীয়তলের বিভিন্ন স্যুইটে হলেও আমার যে কেন ষষ্ঠতলে ঠাঁই হল রহস্যভেদ করা গেল না। চমত্কার বিলাস ব্যবস্থা। যদিও স্যুট সংলগ্ন বাথরুমের ঘরমুখি দেওয়াল আর দরজা দেখে বেশ ধাঁধায় পড়া গেছিল। সবটাই কাচের। এপার ওপার দৃশ্যমান। এ আবার কি ব্যবস্থা ! তবে সম্প্রতি একটি বিজ্ঞাপনে এর ব্যাখ্যা মিলেছে। ভিতর থেকে নাকি টিভি দেখার জন্যই এমন ব্যবস্থা। দ্বিতীয় কোনো ব্যাখ্যা না মেলায় মনে না নিলেও মেনে নিতেই হয়েছে। পাঠকদের কেউ আলোকপাত করলে কৃতজ্ঞ থাকব। ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই মুগ্ধতা গ্রাস করে। সামনে অন্ধকার সাগর। তটরেখা অনেকটা ইংরাজির ইউ আকৃতির হওয়ায় আলোক ঝলমলে শহর যেন মেঘবরণ সাগরকন্যার হীরকদ্যুতির কণ্ঠহার। যদিও এই আলোকমালার দুই তৃতিয়াংশ আকাবার হলেও বাকিটার গৌরব আকাবারই ভগ্নিশহর ইলিয়ট-এর। একেবারে গায়ে জড়ানো দুইবোন। এক নাম না হয়ে ভিন্নতার কারন দুই শহর দুই দেশে অবস্তিত। জর্ডন আর ইজরায়েল। ঢিল ছুঁড়লেই যেন পড়বে সে দেশে।

  রাতে আলোকজ্বল আকাবায় ইতিউতি পদচারণা। একাই। বাকিরা ক্লান্তিতে যে যার সুখসজ্জায়। বাতাসে হালকা শিরশিরানি। হঠাত্ আব্দুল এসে জোটে। প্রস্তাব দেয় বাইরে ডিনার করার। এক কথায় রাজী। মনে নেই রেস্তোঁরার নাম। তবে নতুন অভিজ্ঞতা লাভ হল। ছোট অ্যাকোরিয়ামে রাখা নানান জীবন্ত মাছ। আছে লবস্টার, টুনা, ক্র্যাব আর বাকিরা অপরিচিত। যাকে পছন্দ হবে তাকেই বের করে রান্না করে হাজির করা হবে টেবিলে। পছন্দটা আব্দুলের ঘাড়েই বর্তালো। তবে রসনার তৃপ্তিটা লেখকের নিজস্ব।

  আকৃতিতে জর্ডনের চতুর্থ আর প্রাচীনত্বে সেদেশের দ্বিতীয় শহর আকাবা। রাজ্যের একমাত্র বন্দর শহরও বটে। আকাবা শব্দটির মানে বোঝা, ইংরাজিতে বার্ডেন। জনসংখ্যা ৯৮,৪০০। মানুষের বসবাস দীর্ঘ ছয় হাজার বছর ধরে। মে থেকে অগাস্ট গরমে কলকাতার সঙ্গে ফারাক নেই কোনো। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি সেরা সময়। হাল্কা শীতের ছোঁয়া। এখান থেকেই লোহিত সাগরে ভ্রমণ। নামে লোহিত সাগর বা রেড সী হলেও জলের রঙ গাঢ়় নীল। লোহিত সাগরের উত্তরের এই অংশটি গাল্ফ অফ আকাবা নামেও পরিচিত। আমাদের জলযান বারাকাহ্ আসলে একটি বিলাসবহুল ইয়ট।

  শুরু হল ভেসে পড়া। গন্তব্য ২৭ নটিকাল মাইল দক্ষিনে। উদ্দেশ্য প্রবাল প্রাচির দর্শন। যার জন্য এর নাম লোহিত সাগর। ইয়ট থেকে দুই ভগিনী শহরের রূপে মুগ্ধ হতে হয়। ডানদিকে খানিকটা এগোতেই যে তটরেখা ইজরায়েলের সীমানা ছাড়িয়ে তা আফ্রিকা মহাদেশের শুরু। মিশর দেশ। দুটি হোটেলও চোখে পড়ে। ইয়টের আপার ডেকে তখন গুছিয়ে আড্ডা আর আব্দুলের মুখনিসৃত গল্প। বেদুইন হবার শখ যখন মিটেছে তখন নাবিক হওয়ার ইচ্ছেটাই বা অধরা থাকে কেন। ক্যাপ্টেনের সৌজন্যে হুইল ঘোরনোর মারপ্যাঁচ রপ্ত হতে সময় লাগলো না মোটেই। ব্যাস আর কি ! সারেঙের কুর্সিতে।

  প্রায় মিনিট চল্লিশ পর নোঙর করা হল। যে প্রশ্নটা তাড়া করে ফিরছিল আকাবা আসা ইস্তক তার জবাব মেলায় সকলেই স্বস্তিতে। দলের দু-একজন সাঁতার জানলেও বেশিরভাগেরই জানা নেই। আর স্কুবার অভিজ্ঞতা তো সকলেরই শূণ্য। তাহলে ! প্রবাল প্রচির দর্শন হবে কি করে? ছোটো দুটি মোটর চালিত নৌকা ইয়টের গায়ে ভিড়তেই জানা গেল সামাধানসূত্র। ওগুলি গ্লাসবোট। তলাটা কাচের তৈরি। যেখানে রিফ আর জলের উপরিতলের দূরত্ব কম সেখানে স্বচ্ছ নীল জলে অনায়াসেই মিলবে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর সুযোগ।

  জলের এই অংশের রঙ অনেকটা তুঁতে বর্ণের। ডিসকভারি বা ন্যাটজিওয় দেখা ছবি হঠাত্ বাস্তবায়িত হওয়ায় উত্তেনায় বাকরহিত সবাই। হোক না খানিকটা অস্পষ্ট ! থাক না মাঝে কাচের দেওয়াল ! নাই বা ছোঁয়া গেল নিজের হাতে ! চাক্ষুশ তো হল প্রবাল প্রাচির। সঙ্গে নাম না জানা বেশ কিছু রঙীন মাছ। অনেকটা বিশাল অ্যাকোরিয়ামে জলচর দেখার অনুভূতি। জানা গেল ১৩০ রকমের প্রবাল প্রাচির আছে এ সাগরে। আছে ১৬১ প্রজাতির মাছ। তাদের নামের বাহারও তেমন। বাটারফ্লাই ফিশ, প্যারট ফিশ, লায়ন ফিশ

  টুনা ফিশ আর চিকেন। বার-বি-কিউ এর পদ। ইয়টেই। হঠাত্ ফিশ খাওয়ার উত্সাহ উধাও। শুধু চিকেনেই মনোযোগ কেন্দ্রিভূত। বোধহয় সদ্য রঙবেরঙের মাছদের দেখে আসার সাইড এফেক্ট এর প্রভাব খাদ্য-খাদক সম্পর্কে। ওই দিনই ফেরার পালা। ফেরা মানে ঘরে ফেরা। সীগালদের ডাকে যেন সেই ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত। মন উদাস। হঠাত্ মন কেমন জর্ডনকে বিদায় জানাতে। স্বদেশীয় লক্ষী শরত্, অদিতি দে, রিঙ্কি দাস ভট্টাচার্য, অমিত ঘোষ আর মৃণালকান্তি সরকাররা থাকবে আরও কিছু ঘন্টা। আব্দুল, মার্গারেট, ইলিনা, হিন্দ, মহম্মদ ভাই বা পেট্রার আল কান্তারাহ রেস্তোঁরার মালিক জর্ডনিয় আল পাচিনোর সাথে আর কি দেখা হবে কোনোদিন? নাকি স্মৃতির সাথে তারাও ফিকে হয়ে যাবে কালের নিয়ম মেনে? এই সাতটা দিন সাত রাজার ধন হয়ে তবে মনের মণিকোঠাতেই থাকুক। সুযোগ পেলে আবার দেখা হবে জর্ডন। দেখা হবে আম্মান। তোমার ৮০০০ বছেরের স্মৃতির কোনো এক কোনায় পারলে স্থান দিও এই ছয় ভারতীয় সাংবাদিককে।

 

হারানো শহরের পথে।

পাহাড়ের আড়ালে লুকনো শহর, ভারতীয় পরিচয়ে এক সুইস অভিযাত্রী, হিন্দি গান শোনানো রেস্তোঁরা মালিক, অনন্যসাধারণ বালিস্কযর্, হিন্দি নামধারী বেদুইন সুন্দরী এবং নীলনয়না মেমসাহেব বেদুইন ঘরণি ! একটার সাথে আর একটার যোগ নেই কোনো কিন্তু পেট্রা নিয়ে লিখতে বসলে কাউকেই বাদ দেওয়ার উপায় নেই।

জর্ডনের রাজধানী আম্মান থেকে ২৮০ কিমি দূরত্ব পেট্রার। পাহাড়ি ঢালের আধুনিক জনপদটির আসল নাম ওয়াদি মুসা বা মুসার উপত্যকা। পয়গম্বর মুসা বা মোজেস এ পথেই পাড়ি দিয়েছিলেন পবিত্র ভূমি দর্শন করতে। তাই এই উপত্যকার এমন নাম।

  পৌঁছতে রাত হওয়ায় হারানো শহর পেট্রা দেখতে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই। তবে রাতের আহারপর্বের চমকের জন্য প্রস্তুতি ছিল না। আল-কান্তারাহা এখানকার অভিজাত রেস্তোঁরা। আহারের আয়োজনে ঘট উল্টনো দেখে মন দমে যেতেই পারে। শুরুর আগেই কি শেষ নাকি! বসার পর স্বস্তি মিলল যখন সার্ভিস করতে এসে ধোপদুরস্ত ওয়েটার ঘটটা সোজা করলেন। বিরিয়ানি সদৃশ ধোঁয়া ওঠা পদ। মন মাতানো গন্ধে নেই বিরিয়ানির পরিচিতি। চাল আর ভেঁড়ার মাংস প্রধান উপকরণ হলেও এ পদের নাম ম্যাকলুবা। গন্ধের মতনই স্বাদেও নেই বিরিয়ানির সাথে দুর-দুরান্তের কোনো আত্মীয়তা। অদ্ভুত্ স্বর্গীয় অভিজ্ঞতার সাক্ষী হল রসনা।

  চমকের বাকি ছিল তখনও। এবার ধন্য শ্রবণ যন্ত্র। খালি গলায় হিন্দি গান। গায়ক রেস্তোঁরা মালিক ইয়াহিয়া হাসান। ভারতীয় সাংবাদিককে জর্ডনিয় উপহার। কখনও সত্তে পে সত্তা কখনও বা অমর আকবর অ্যান্টনি। অথচ হিন্দি জানেন না এক বর্ণও! বাংলা তো দূর অস্ত। ভারতীয়দের মধ্যে এ দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ যে অমিতাভ বচ্চনকেই চেনেন তা বলা বাহুল্য মাত্র। জনপ্রিয়তার নিরিখে দুই এবং তিন নম্বরে দুই বঙ্গসন্তান। না, ছাপার ভুল নয়। প্রমান কানে কানে। মালিকের গলায়, আমরা অমর সঙ্গী গানে। জনপ্রিয় দুই বঙ্গসন্তান যথাক্রমে মিঠুন চক্রবর্তী এবং বাপি লাহিড়ি। গায়ক ছাড়াও ইয়াহিয়া হাসানের মধ্যে নায়ক হওয়ার উপাদানও মজুত। চেহারায় একেবারে অল্পবয়সী আল পাচিনো।                                          

  গ্রিক শব্দ পেট্রা কথাটার মানে বড় প্রস্তর খণ্ড। আরবি ভাষায় আল বাত্রা। হোড় পাহাড়ের ঢালে ঢালে বেলে পাথর কুঁদে নির্মান আস্ত একটা শহরের! যে শহরের কোনো হদিশ মিলবে না পাখির চোখ দিয়ে দেখলেও। তাই দীর্ঘ দেড় হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এ শহরের হদিশ পাননি তামাম দুনিয়াবাসী।

  ১৮১২ সালে এক সুইস অভিযাত্রী বেদুইন উচ্চারণে আরবি ভাষা শিখে এখানে হাজির হন। নিজেকে ভারতীয় মুসলিম পরিচয় দিয়ে ভাব জমান স্থানীয় বেদুইন রক্ষকদের সঙ্গে। যাঁরা দুনিয়াবাসীর সঙ্গে পেট্রার গোপনীয়তা ভাগ করতে রাজী ছিলেন না। পয়গম্বর মুসার ভাই অ্যারনের সমাধিক্ষেত্রে যাওয়ার আছিলায় তিনি খুঁজে পেলেন হারিয়ে যাওয়া শহর পেট্রাকে। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো পেট্রাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা দেয়।

  সংরক্ষিত অঞ্চলের দরজা পার হওয়ার মূল্য ৫০ জর্ডনিয়ান দিনার। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৪২৫০ টাকা। আর ঐতিহাসিক মূল্যে পাঁচ পয়জার। এখনও পর্যন্ত হারানো শহরের মাত্র ২৬৪ বর্গ কিমি খুঁজে পাওয়া গেছে। সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে ৮০০টি সৌধ।

  অতঃপর স্মৃতি সৌধ সন্দর্শনে সরণ শুরু অন্তস্থলে। ঢালু পথ নেমে গেছে এঁকেবেঁকে। মোট প্রায় ৪ কিমি হাঁটাপথ। ঘোড়সওয়ারি বা এক্কাগাড়িও মেলে,  কড়রি ফেলে। তবে ইতিহাসে মজতে ১১ নম্বরই সেরা। খ্রিস্ট জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে নির্মাণ শুরু এ শহরের। নাবাত্ সভ্যতা। সম্ভবত আরব মুলুকের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে আগমন নাবাত্দের। প্রথম বহির্জগতের অনুপ্রবেশ ৩১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। আলেকজান্দারের সেনাপতি আন্তিগোনের নেতৃত্বে আক্রমণ গ্রিক সেনাদের। নির্বিচার গণহত্যা আর লুণ্ঠন। মূলত রূপোর লোভে। কার্যত পেট্রার পতনের সেই শুরু। ৩৬৩ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ ভূকম্পে যে সভ্যতা ঘুমিয়ে পড়ে চিরতরে।

  পথ আগলে দুই নাবাত্ সেনা। পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য। খেয়াল হল দুদিকে ঘনিয়ে এসেছে পাহাড়ের দেওয়াল। সরু ফাটলের মতন পথ চলে গেছে দৃষ্টিসীমার বাইরে। এ কোনো প্রাকৃতিক ফাটল নয়। নাবাত্ রা তৈরি করেন ভূমিকম্প এবং বন্যার মতন প্রকৃতির রোষ থেকে বাঁচতে। এই ফাটলকে বলা হয় সিক। ১ দশমিক ২ কিমি হাঁটাপথ এই সিক এর মধ্য দিয়েই। এক্কাগাড়ি চলাচলের উপযুক্ত প্রশস্ত। পর্বতগাত্রের বামধার বরাবর নালার মতন সরু পরিখা। পানীয় জল যাওয়ার পথ। মাঝে মাঝেই কৃত্রিম অগভীর গহ্বর নালার ভিতর। সেযুগের ওয়াটার ফিল্টার।

  নাবাত্দের ধর্ম সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেল একটু পরেই। পাথরের স্তূপ। একধার মসৃণ করা। যার উপর খোদাই করা দেবদেবীর মুখ। বুঝে নিতে হবে। শুধু চোখ আর নাকের সাজেশন। ঠোঁঠ নেই। দ্য সাইলেন্ট গড, তাই। এই স্তূপকে প্রদক্ষিণ করাই ছিল পুজোর রীতি।

  চোখে পড়ল দুদিকের পাহাড়ের গায়ে প্রচুর অগভীর কুলুঙ্গি। যাতে ছোটোছোটো নানান আকৃতি। অর্ধেক ডিমের মতন দেখতে খোদাই বেশিরভাগ কুলুঙ্গিতে। নাবাত্-রা মানত পূরণ করতেন এভাবেই। কেশ বিসর্জনের বদলে কুলুঙ্গি খনন। আর ঐ অর্ধেক ডিম্বাকৃতি মূর্তি তাঁদের সূর্য দেবতা।

  আরও খানিক চলার পর গাইড আব্দুলের নির্দেশ, সবাইকে এবার ডানদিক ঘেঁষে নিজ নিজ পায়ের পাতার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দশ পা হাঁটতে হবে। মাথা নতই থাকবে, উচ্চ শির নয়। হবে হয়তো নাবাতিয় কোনো রীতি। দশপদি গমণের পর আব্দুলবাণি, “নাও লুক অ্যাহেড। ইয়াল্লা, ইয়াল্লা (তাড়াতাড়ি)”।

  মাথা তুলতেই বিস্ময়ের বিস্ফোরন। আলাদিনের জিনি হঠাত্ হাজির করেছে সুবিশাল প্রাসাদ। যার প্রবেশপথটুকুই দৃষ্টিগোচরে তখন।

  কিন্তু এ যে ভীষণ চেনা! এর ভিতরেই রাখা ছিল না সেই পবিত্র পানপাত্রটি! দ্য হোলি গ্রেইল! যা উদ্ধার করতে এসে আর একটু হলেই প্রাণ খোয়াচ্ছিলেন সঁ কোনারি এবং হ্যারিসন ফোর্ড। হিটলার অনুগামী দুর্ধর্ষ নাত্সী সেনাদের হাতে।

  নস্টালজিয়ার ঝোঁকে লেখার ভুল নয়, ১৯৮৯ সালের স্পিলবার্গ মুভি ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড হিস লাস্ট ক্রসেড ছবির ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যের প্রবেশপথ।

  আদতে নাবাত্ সভ্যতার শ্রেষ্ঠ কীর্তি আল খাজানা বা ট্রেজারি বিল্ডিং। আবার ভুল হল। আসলে তাও নয়। প্রায় দুহাজার বছরের নাবাত্ সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক চতুর্থ আরাতাসের সমাধি।

  পাহাড়ের গা কেটে নির্মিত এই সৌধটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল দুশো বছর! সমাধিটি সৌধের ভিতরে। ধন্দ লাগলো প্রবেশদ্বারের মুখেই রোমানশৈলিতে নির্মিত ৬টি করোন্থিয়াল কলাম দেখে। পুরোটা ভাল করে দেখে এবং আব্দুলের সাহায্য নিয়ে উদ্ধার হল নাবাত্ সভ্যতায় নানাশৈলি মিশেলের রহস্য। গ্রিক, ইজিপশিয়ান, রোমান এবং মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার অনেক কিছুই গ্রহণ করেছিলেন নাবাত্ রা।

  পেট্রা বেসিনের এই অংশে উপস্থিত পর্যটকদের শাটারের ঘন ঘন ক্লিক ধ্বনিতে তখন কান পাতাই দায়।

  জানা গেল আগে ভিতরে ঢুকে সমাধি দর্শন করা গেলেও এখন জনসাধারনের প্রবেশ নিষেধ। কারণটি বিস্ময়কর। শুধু ভারতীয়রাই নন বিশ্বের বহু দেশের নাগরিকদের মধ্যেও সেই একই রোগ বিরাজমান। ঐতিহাসিক সৌধে নাম লিখে নিজেদের রোমিও-জুলিয়েট বা হীর-রঞ্ঝা র সমতুল মনে করার বিফল কিন্তু বিষময় প্রয়াস।

  আল-খাজানার মায়া কাটিয়ে খানিক এগোতেই চোখে পড়ল তাঁবু খাটানো এক বিচিত্র দর্শন সু্যভেনির শপ। ‘ওয়ার্ল্ড ফেমাস স্যান্ড আর্ট অব পেট্রা’। পেট্রার বিশ্ববিখ্যাত বালিস্কর্য ! সরু মুখ ছোটো ছোটো বোতলে রঙবেরঙের বালি ঢেলে নানান ছবি। দক্ষ হাতের নিপুণ চালুনিতে সরু সরু শিকের খোঁচায় মূর্ত হচ্ছে কখনও মানুষের মুখ, কখনও বা মরুভূমিতে হেঁটে যাওয়া উঁট ! জাদু মাখা ঘোর লাগলো চোখে।

  প্রতি শিশি মাত্র দশ জর্ডনিয়ান দিনার। পর্যটকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি প্রিয়জনকে পেট্রার স্মরণ উপহার তুলে দেওয়ার।

  এদের রক্তেই বোধহয় কারু সুক্ষতা। প্রমাণ এই ঐতিহাসিক স্থানে প্রবেশ করা ইস্তক মিলছে। আরও একবার পাওয়া গেল। একটি অ্যাম্পি-থিয়েটার চোখে পড়ার পর। একটা আস্ত পাহাড়কে কুঁদে কুঁদে চোদ্দশো আসন বিশিষ্ট বিশাল এই অ্যাম্পি-থিয়েটার নির্মাণ সম্ভব না দেখলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হত !

  প্রাণটা অনেকক্ষন থেকেই চা চা করছিল। বেদুইনদের বিখ্যত পুদিনা চা মন কেড়েছে আগেই। ঐতিহাসিক স্থান হলেও নির্দিষ্ট জায়গা করা আছে সু্যভেনির শপ, চা এর দোকান বা ছোটোখাটো ইটারিস এর জন্য। তেমনই এক দোকানে চায়ের সন্ধানে প্রবেশ। তরুণী এক বেদুইন সুন্দরী যার মালকিন। নাম- হিন্দ ! বাবা মা ছিলেন হিন্দি সিনেমার বেজায় ভক্ত। যদিও না তাঁরা না ‘হিন্দ’, হিন্দি জানেন না কেউই !

  হিন্দ মাত্র দুজন ভারতীয়কে চেনেন। অমিতাভ বচ্চন এবং মিঠুন চক্রবর্তী। যদিও সে নিজে দ্বিতীয়জনের ভক্ত। পুদিনা চা এ চুমুক দিতে দিতেই সংলগ্ন পাহাড় ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠা প্রাসাদ দর্শন সম্পন্ন হল।

  আব্দুলের তাড়ায় আবার একটি সু্যভেনির শপে ঢুকতে আপত্তি ছিল বিলকুল। ভাগ্যিস আপত্তি তে কান দেয় নি আব্দুল ! না হলে হয়ে যেত চরম ভুল !

  মার্গারেট ফ্যান গেল্ডিরম্যালসেন। আদতে নিউজিল্যান্ড নিবাসিনী এই মধ্যযৌবনা বর্তমানে জর্ডনের নাগরিক। ১৯৭৮ এ বেড়াতে এসে আর ফেরা হয় নি। ফাঁদে পড়েছিলেন যে ! জানতেন না জর্ডনের পেট্রায় মোহময়ী ফাঁদ পেতে রেখেছেন বিধাতা তাঁর জন্য। প্রেমের ফাঁদ।

  স্যুভেনির শপে কেনাকাটা করতে ঢুকে বিক্রেতা বেদুইন মহম্মদের সঙ্গে চার চক্ষুর মিলনে নিজেই নিউজিল্যান্ডের স্মারক হয়ে এদেশে রয়ে যাবেন জানা ছিল না মার্গারেটের। বেদুইনকে বিয়ে। বেদুইনি সংসার। গুহাতেই মধুচন্দ্রিমা।

  তখন এখানকার গুহায় এবং তাঁবু খাটিয়ে থাকতেন অনেক বেদুইন-ই। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণার পর পুণর্বাসন। কাছেই একটি গ্রামে সরকারি ব্যবস্থায়। সেই ইস্তক দোকানদারিতে স্বামীকে সাহায্য করতেন। পর্যটকরা এসে অবাক বিস্ময়ে শুনতে চাইতেন অসাধারণ এই প্রেম উপাখ্যান। ২০০২ এ মহম্মদের মৃত্যর পর শুরু করেন সেই রোমাঞ্চভরা স্মৃতি নিয়ে লেখনি। ২০০৬ এ প্রথম প্রকাশ তাঁর ‘ম্যারেড টু আ বেদুইন’ প্রেমগ্রন্থটির। এর মধ্যেই দশম সংস্করণ নিঃশেষ !

  পেট্রা শুধু হারানো শহরই নয়। আরও অনেক কিছু। নাবাত্ থেকে মার্গারেট অনেক রোমাঞ্চ অনেক কাহিনীর ভীতে তিল তিল করে তিলোত্তমা পেট্রা। সাত সাগর আর তেরো নদী পেরিয়ে মার্গারেট খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নের রাজপুত্র। যেখানে লালচে বেলে পাথুরে রঙে মিশে যায় অস্তগামী সূর্যের রঙ। হোড় পাহাড়ের কাস্তে ফাটলে মিলেমিশে এক হয় ইতিহাস আর ভালবাসা। পরিব্রাজক নুড়ি বাছে সময়ের তুলনায়। আদম আর ঈভ নৃতত্বকে থোড়াই কেয়ার করে। বারে বারে জন্মায় ইতিহাসের আঁতুর ঘরে। চক-পেন্সিলে নাম লেখার দরকার পরে না ইতিহাসকে বিপন্ন করে।

  পেট্রার স্মৃতি পোক্ত হওয়ার প্রতিশ্রুতি বুকে পরবর্তী গন্তব্যের ডাক শোনা যায় বর্তমানের জঠর থেকে।

(আনন্দবাজার পত্রিকা, মুম্বই সংস্করনে প্রকাশিত। তারিখ-১৩/০৪/২০১৪)